০৫:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অসংখ্য নবী-রাসূলের পদধন্য আল-আকসা আবার আনন্দে হাসবে

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৬:৩১:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ নভেম্বর ২০২৩
  • 33

পৃথিবীর বরকতময় ও স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের সুন্দর সুশোভিত প্রাচীনতম জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা। মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা ও পৃথিবীর বুকে অবস্থিত সব জাতি-বর্ণের মুসলমানদের প্রাণস্পন্দন।অন্যদের মাধ্যমে দখলকৃত যেকোনো মুসলিম ভূখণ্ড উদ্ধার করা সমগ্র মুসলমানদের অপরিহার্য বিষয়। তবে ইসলামের প্রথম কিবলার দেশ ফিলিস্তিনের বিষয়টি অন্যসবগুলোর চেয়েও ভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ। আর জেরুজালেমের এই স্থানটিকেই নিজেদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে ইহুদি এবং খ্রিস্টানরাও। ১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে যুদ্ধের পর মসজিদটি দখল করে নেয় ইসরাইল। এরপর থেকে মসজিদটিতে ইবাদতের জন্য দখলদার বাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই তাকিয়ে থাকতে হয় ফিলিস্তিনের সাধারণ মুসল্লিদের।সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীর পরই, মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ।

খৃষ্টপূর্ব ১০০৪ সালে মসজিদটি পুন:নির্মাণ করেন হযরত সোলায়মান আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এরপর বিভিন্ন সময়ই এর সংস্কার করা হয়। দু’টি বড় ও ১০টি ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে প্রকাশ পেয়েছে নির্মাণশৈলীর এক মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি।বিভিন্ন সময়ে মসজিদটি সংস্কারে ব্যবহার করা হয় মার্বেল, স্বর্ণসহ নানা ধরণের মূল্যবান ধাতু ও পাথর। ঐতিহাসিকভাবেই আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদেরই পবিত্র স্থান। তারপরেও এটিকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ইউনেস্কো।১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইল। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে যুদ্ধে, আল-আকসা মসজিদ দখল করে নেয় দেশটি। এরপর থেকেই এটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দখলদার বাহিনী। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আল-আকসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল ইসরাইল। এমনকি ১৯৬৯ সালে পবিত্র মসজিটিতে অগ্নিসংযোগও করেছিল দখলদাররা। এরপর নানা বিধি-নিষেধ আর শর্ত পূরণের মাধমে সেখানে ইবাদতের সুযোগ পেতেন সাধারণ মুসল্লিরা।

এরপরও কয়েকবার বিভিন্ন অজুহাতে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী আল-আকসা মসজিদ ফিলিস্তিনিদের জন্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৩ সালে জেরুজালেমে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের আল-আকসায় প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরাইল। এরপর থেকে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়। বিভিন্ন সময় ইহুদিরা মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুসল্লীদের ওপর হামলা চালায়। ইহুদিদের কাছে এই স্থানটি টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত। তাদের দাবি, এর নিচেই রয়েছে তাদের দু’টি প্রাচীন মন্দির। অন্যদিকে খ্রিস্টানরাও আল-আকসা মসজিদের স্থাপনাকে তাদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে। মসজিদ আল-আকসাসহ অসংখ্য নবি-রাসুলদের স্মৃতি বিজড়িত যার চত্ত্বরে আজো অসংখ্য নবি-রাসুলের সমাধি বিদ্যমান। মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেকরই অজানা। যারা তা জানে না তাদের জন্যই এ সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা-বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিষ্ঠামুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর নাতি বনি ইসরাইলের প্রথম নবি হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ শহর জেরুজালেমে মসজিদ আল-আকসা নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম জিন জাতির মাধ্যমে এ পবিত্র মসজিদ পুনঃনির্মাণ করেন। ইসলামের আগমনের পর প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরে ইন্তেকালের কয়েক বছর পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের অধীনে আসে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ মসজিদটি কিছু দিনের জন্য মুসলমানদের কেবলা হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল।

১৫ জুলাই ১০৯৯ সাল। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক বেদনাদায়ক দিন। সে দিন অযোগ্য মুসলিম শাসকদের ছত্রছায়ায় খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনী সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এর পরই ঘটতে থাকে হৃদয় বিদারক অসংখ্য ঘটনা। যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। এ খ্রিস্টানরা ১০৯৯ সালের ৭ জুন প্রথমে জেরুজালেমে অবস্থিত ‘বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদ আল-আকসা’ অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে। অতঃপর এ পবিত্র মসজিদে তারা তাদের উপাসনালয় গির্জায় পরিণত করে। ২৩ মার্চ ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করে। ফাতেমীয় খেলাফতের রাজত্বকালে খলিফার নিদের্শে সেনাপতি হজরত সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। ২০ সেপ্টেম্বর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে রক্তক্ষয়ী সমরাভিযানের মাধ্যমে তিনি মসজিদ আল-আকসাসহ পুরো ঐতিহাসিক জেরুজালেম নগরী মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।

২ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি ও গভর্নর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীবেশে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি কর্তৃক বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হওয়ার পর জেরুজালেমে দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দিব্যাপী মুসলমানরা খ্রিস্টানদের অত্যাচার থেকে মুক্ত ছিল। বর্তমানে ‘আল-আকসা’ মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ এ ৩টির সমন্বয়; যা ‘হারাম আশ শরীফ’ এর চার দেয়াল এর মধ্যেই অবস্থিত। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি. বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুননির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।

বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। বর্তমানে জেরুসালেম দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদটি রয়েছে জর্ডানি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে।ঐতিহাসিক এ স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আমাদের নানা স্মৃতি। এখানেই শুয়ে আছেন হযরত ইব্রাহিম এবং মুসা আ. সহ অসংখ্য নবী রাসুল। এখানেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. সকল নবী রাসুল এবং ফেরেস্তাদের নিয়ে নামাজ পড়ছিলেন। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই। এখান থেকেই হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকে করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন। এই মসজিদ নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে হজরত আদম আলাইহিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম এর নাম। জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ জাহানের শাসক হজরত উমর (রা), দ্যা গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীসহ অসংখ্য বীরদের নাম।

এই মসজিদে ২ রাকাআত নামাজ আদায় করলে একজনের আমল নামায় ৫ শত রাকাআত নামাজের সমপরিমাণ সওয়াব লিখা হয়। পবিত্র কোরআনের প্রায় ৭০ জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে এ মসজিদের কথা।প্রথম নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে, মসজিদুল আকসা অর্থ ‘দূরবর্তী মসজিদ’। মিরাজের রাতে হজরত রসুলে করিম (সা.) বোরাকে চড়ে মক্কা থেকে এখানে এসেছিলেন। অনেক বছর ধরে মসজিদুল আকসা বলতে পুরো এলাকাকে বোঝানো হতো এবং মসজিদকে আল-জামি আল-আকসা বলা হতো। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে বাদশাহ সলোমন বা সুলাইমান (আ.) নির্মাণ করেন এই ‘প্রথম মসজিদ’ বা বাইতুল মুকাদ্দাস নামে চিরচেনা মসজিদ আল-আকসা। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয় মসজিদ কাঠামোটি। পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবেলের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে নির্মিত হয় দ্বিতীয়বার এই মসজিদ সেই আগের জায়গায়ই। মুসলিমদের প্রথম কিবলা এই মসজিদ আল-আকসা ইহুদিদেরও প্রার্থনার কেন্দ্রস্থল।

এই মসজিদ আল-আকসার দিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করতেন মদিনায় হিজরতের ১৭তম মাস পর্যন্ত। মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মসজিদ আল-আকসার প্রথম নির্মাণের আগেই দাঁড়ানো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সুলাইমান (আ.)। অন্যদিকে ইহুদিদের কিতাবগুলোতে এই আল-আকসা নিয়ে প্রচুর বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরাও ধ্বংস করে দিয়েছিল এই আল-আকসা। ইতিহাসের ঘাত- প্রতিঘাতে বহুবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মসলমানদের এই অন্যতম পবিত্র স্থানটি। বর্তমানেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে এই পবিত্র জায়গাটির ওপর দিয়ে। হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী এই মসজিদ আল-আকসা।
পরিশেষে বলতে চাই, এই ঐতিহাসিক মসজটির রক্ষাতে একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নেতৃত্বে ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশ জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, মিসরসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো এগিয়ে আসতে হবে।তাই আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি দখলদার জালেম ইসরাইলের এ জুলুমের অবসান একদিন হবে। পবিত্র আল-আকসাকে ঘিরে আবার জেগে উঠবে নিরাপদ প্রাণের স্পন্দন। অসংখ্য নবী-রাসুলের পদধন্য এ ভূমি আবার আনন্দে হাসবে। মহান আল্লাহ কাছে আমরা এ দোয়া করি।

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

অসংখ্য নবী-রাসূলের পদধন্য আল-আকসা আবার আনন্দে হাসবে

Update Time : ০৬:৩১:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ নভেম্বর ২০২৩

পৃথিবীর বরকতময় ও স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের সুন্দর সুশোভিত প্রাচীনতম জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা। মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা ও পৃথিবীর বুকে অবস্থিত সব জাতি-বর্ণের মুসলমানদের প্রাণস্পন্দন।অন্যদের মাধ্যমে দখলকৃত যেকোনো মুসলিম ভূখণ্ড উদ্ধার করা সমগ্র মুসলমানদের অপরিহার্য বিষয়। তবে ইসলামের প্রথম কিবলার দেশ ফিলিস্তিনের বিষয়টি অন্যসবগুলোর চেয়েও ভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ। আর জেরুজালেমের এই স্থানটিকেই নিজেদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে ইহুদি এবং খ্রিস্টানরাও। ১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে যুদ্ধের পর মসজিদটি দখল করে নেয় ইসরাইল। এরপর থেকে মসজিদটিতে ইবাদতের জন্য দখলদার বাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই তাকিয়ে থাকতে হয় ফিলিস্তিনের সাধারণ মুসল্লিদের।সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীর পরই, মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ।

খৃষ্টপূর্ব ১০০৪ সালে মসজিদটি পুন:নির্মাণ করেন হযরত সোলায়মান আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এরপর বিভিন্ন সময়ই এর সংস্কার করা হয়। দু’টি বড় ও ১০টি ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে প্রকাশ পেয়েছে নির্মাণশৈলীর এক মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি।বিভিন্ন সময়ে মসজিদটি সংস্কারে ব্যবহার করা হয় মার্বেল, স্বর্ণসহ নানা ধরণের মূল্যবান ধাতু ও পাথর। ঐতিহাসিকভাবেই আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদেরই পবিত্র স্থান। তারপরেও এটিকে মুসলমানদের পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ইউনেস্কো।১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইল। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে যুদ্ধে, আল-আকসা মসজিদ দখল করে নেয় দেশটি। এরপর থেকেই এটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দখলদার বাহিনী। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আল-আকসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল ইসরাইল। এমনকি ১৯৬৯ সালে পবিত্র মসজিটিতে অগ্নিসংযোগও করেছিল দখলদাররা। এরপর নানা বিধি-নিষেধ আর শর্ত পূরণের মাধমে সেখানে ইবাদতের সুযোগ পেতেন সাধারণ মুসল্লিরা।

এরপরও কয়েকবার বিভিন্ন অজুহাতে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী আল-আকসা মসজিদ ফিলিস্তিনিদের জন্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৩ সালে জেরুজালেমে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের আল-আকসায় প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরাইল। এরপর থেকে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়। বিভিন্ন সময় ইহুদিরা মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুসল্লীদের ওপর হামলা চালায়। ইহুদিদের কাছে এই স্থানটি টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত। তাদের দাবি, এর নিচেই রয়েছে তাদের দু’টি প্রাচীন মন্দির। অন্যদিকে খ্রিস্টানরাও আল-আকসা মসজিদের স্থাপনাকে তাদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে। মসজিদ আল-আকসাসহ অসংখ্য নবি-রাসুলদের স্মৃতি বিজড়িত যার চত্ত্বরে আজো অসংখ্য নবি-রাসুলের সমাধি বিদ্যমান। মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেকরই অজানা। যারা তা জানে না তাদের জন্যই এ সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা-বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রতিষ্ঠামুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর নাতি বনি ইসরাইলের প্রথম নবি হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ শহর জেরুজালেমে মসজিদ আল-আকসা নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম জিন জাতির মাধ্যমে এ পবিত্র মসজিদ পুনঃনির্মাণ করেন। ইসলামের আগমনের পর প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরে ইন্তেকালের কয়েক বছর পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের অধীনে আসে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ মসজিদটি কিছু দিনের জন্য মুসলমানদের কেবলা হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল।

১৫ জুলাই ১০৯৯ সাল। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক বেদনাদায়ক দিন। সে দিন অযোগ্য মুসলিম শাসকদের ছত্রছায়ায় খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনী সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এর পরই ঘটতে থাকে হৃদয় বিদারক অসংখ্য ঘটনা। যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। এ খ্রিস্টানরা ১০৯৯ সালের ৭ জুন প্রথমে জেরুজালেমে অবস্থিত ‘বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদ আল-আকসা’ অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে। অতঃপর এ পবিত্র মসজিদে তারা তাদের উপাসনালয় গির্জায় পরিণত করে। ২৩ মার্চ ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করে। ফাতেমীয় খেলাফতের রাজত্বকালে খলিফার নিদের্শে সেনাপতি হজরত সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। ২০ সেপ্টেম্বর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে রক্তক্ষয়ী সমরাভিযানের মাধ্যমে তিনি মসজিদ আল-আকসাসহ পুরো ঐতিহাসিক জেরুজালেম নগরী মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।

২ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি ও গভর্নর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীবেশে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি কর্তৃক বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হওয়ার পর জেরুজালেমে দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দিব্যাপী মুসলমানরা খ্রিস্টানদের অত্যাচার থেকে মুক্ত ছিল। বর্তমানে ‘আল-আকসা’ মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ এ ৩টির সমন্বয়; যা ‘হারাম আশ শরীফ’ এর চার দেয়াল এর মধ্যেই অবস্থিত। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি. বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুননির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।

বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। বর্তমানে জেরুসালেম দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদটি রয়েছে জর্ডানি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে।ঐতিহাসিক এ স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আমাদের নানা স্মৃতি। এখানেই শুয়ে আছেন হযরত ইব্রাহিম এবং মুসা আ. সহ অসংখ্য নবী রাসুল। এখানেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. সকল নবী রাসুল এবং ফেরেস্তাদের নিয়ে নামাজ পড়ছিলেন। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই। এখান থেকেই হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকে করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন। এই মসজিদ নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে হজরত আদম আলাইহিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম এর নাম। জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ জাহানের শাসক হজরত উমর (রা), দ্যা গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীসহ অসংখ্য বীরদের নাম।

এই মসজিদে ২ রাকাআত নামাজ আদায় করলে একজনের আমল নামায় ৫ শত রাকাআত নামাজের সমপরিমাণ সওয়াব লিখা হয়। পবিত্র কোরআনের প্রায় ৭০ জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে এ মসজিদের কথা।প্রথম নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে, মসজিদুল আকসা অর্থ ‘দূরবর্তী মসজিদ’। মিরাজের রাতে হজরত রসুলে করিম (সা.) বোরাকে চড়ে মক্কা থেকে এখানে এসেছিলেন। অনেক বছর ধরে মসজিদুল আকসা বলতে পুরো এলাকাকে বোঝানো হতো এবং মসজিদকে আল-জামি আল-আকসা বলা হতো। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে বাদশাহ সলোমন বা সুলাইমান (আ.) নির্মাণ করেন এই ‘প্রথম মসজিদ’ বা বাইতুল মুকাদ্দাস নামে চিরচেনা মসজিদ আল-আকসা। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয় মসজিদ কাঠামোটি। পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবেলের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে নির্মিত হয় দ্বিতীয়বার এই মসজিদ সেই আগের জায়গায়ই। মুসলিমদের প্রথম কিবলা এই মসজিদ আল-আকসা ইহুদিদেরও প্রার্থনার কেন্দ্রস্থল।

এই মসজিদ আল-আকসার দিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করতেন মদিনায় হিজরতের ১৭তম মাস পর্যন্ত। মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মসজিদ আল-আকসার প্রথম নির্মাণের আগেই দাঁড়ানো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সুলাইমান (আ.)। অন্যদিকে ইহুদিদের কিতাবগুলোতে এই আল-আকসা নিয়ে প্রচুর বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরাও ধ্বংস করে দিয়েছিল এই আল-আকসা। ইতিহাসের ঘাত- প্রতিঘাতে বহুবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মসলমানদের এই অন্যতম পবিত্র স্থানটি। বর্তমানেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে এই পবিত্র জায়গাটির ওপর দিয়ে। হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী এই মসজিদ আল-আকসা।
পরিশেষে বলতে চাই, এই ঐতিহাসিক মসজটির রক্ষাতে একজন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নেতৃত্বে ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশ জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, মিসরসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো এগিয়ে আসতে হবে।তাই আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি দখলদার জালেম ইসরাইলের এ জুলুমের অবসান একদিন হবে। পবিত্র আল-আকসাকে ঘিরে আবার জেগে উঠবে নিরাপদ প্রাণের স্পন্দন। অসংখ্য নবী-রাসুলের পদধন্য এ ভূমি আবার আনন্দে হাসবে। মহান আল্লাহ কাছে আমরা এ দোয়া করি।