০২:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিষদ স্বাদের লকডাউ‌ন সমাচার।

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৩:০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুন ২০২১
  • 14

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের পাদুর্ভাবে মানুষের যাপিত জীবনে অপরিকল্পিত ও প্রশাসনের সম্বয়হীনতার নানান নামের লকডাউনে বিপর্যস্ত বিভ্রান্ত মানুষ। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ‘বিধিনিষেধ’, ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ ‘সীমিত পরিসরে লকডাউন’, ‘অঞ্চলভিক্তিক লকডাউন’, ‘সারা দেশে লকডাউন’, ‘কঠোর লকডাউন’ ‘শাটডাউন’ নামের সিদ্ধান্তগুলো কর্মজীবী মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর নামে কয়েক মাস থেকে পরিকল্পনাহীন, সমন্বয়হীনতা, সীমান্ত বন্ধ নানান ধরনের বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে; কিন্তু সেসব বিধিনিষেধের কর্মসূচি কার্যকরে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না। দীর্ঘদিন করোনার কারণে এসব বিধিনিষেধে স্বল্প আয়ের মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী, চাকরিজীবীর দুর্দশা বাড়াচ্ছে, পকেটে টান পড়ে গেছে অথচ করোনা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ২৬৮ জন। সংক্রমণের হার ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এটাকে ভয়াবহ চিত্র মনে করছেন। অথচ করোনাভাইরাস ঠেকানোর কর্মসূচির নামে ছেলেখেলা চলছে মাসের পর মাস ধরে।

মূলত করোনা ঠেকানোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে আবার সে সিদ্ধান্তের ঘনঘন পরিবর্তনের ফলে সরকারের কঠোর সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে কর্মজীবী মানুষ রুটিরুজির জন্য একদিকে বেপরোয়া হচ্ছেন, স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই রাস্তায় নামছেন; অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রাস্তায় নামায় গাদাগাদি করে চলাফেরা করায় করোনা আরো বিস্তার ঘটাচ্ছে। করোনার লকডাউন ঘোষণা দেয়া হচ্ছে অথচ দুস্থ ও গরিব মানুষের আর্থিকভাবে সহায়তা করা হচ্ছে না। লকডাউন বাস্তবায়নে সরকারের হার্ডলাইন আর সফটলাইনের ‘লকডাউন’ কর্মসূচির গ্যাঁরাকলে মানুষ পড়ে গেছে। গতকালও চাকরি হারানো, ব্যবসার পুঁজি ভেঙে খাওয়া বিপন্ন মানুষকে দেখা গেছে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটে যেতে। আর আর্থিক কষ্টে থাকা এই গ্রামমুখী মানুষকে পথেঘাটে পড়তে হয় চরম ভোগান্তির মুখে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘শাটডাউন, লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধ-একেক সময় একেক শব্দ ব্যবহারের কারণে নানা দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। একটা কঠোর বিধিনিষেধ চলমান আছে। তাহলে সোমবার থেকে বুধবার আবার সীমিত বলায় জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। ১ জুলাই থেকে যে কঠোর লকডাউন দেওয়া হবে, সেটি যেন আসলেই কঠোর হয়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তবে সিদ্ধান্ত ঘনঘন পরিবর্তন করায় মানুষ আস্থাহীনতায় ভুগছে’।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সোম থেকে বুধবার আমরা কী করবÑ তার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ব্যবসায়ীদের সামনে নেই। সোমবার থেকে লকডাউন শুনে আমরা সব বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেই। কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় কঠোর লকডাউন পেছানোর ঘোষণায় আমরা সংশয়ে রয়েছি। এরই মধ্যে দোকান কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে এখন বিপাকে পড়ে গেছেন অনেক ব্যবসায়ী’।

‘লকডাউন’ শব্দটি শুনলেই আতকে উঠেন পেশাজীবীরা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মুটে-মজুর, সীমিত আয়ের মধ্যবৃত্ত, বেসরকারি চাকরিজীবী, নিম্নআয়ের মানুষ ‘লকডাউন’ শুনলেই আতঙ্কে পড়ে যান। দিন এনে দিনে খাওয়া এসব মানুষ পথে বের হতে না পারলে বা কাজ করতে না পারলে, ঘরে বসে খাবেন কি? আবার যারা রাজধানী ঢাকায় থাকেন, তাদের পেটের চিন্তার পাশাপাশি রয়েছে বাসাভাড়ার ভয়। ফলে মিডিয়ায় লকডাউন বা বিধিনিষেধের খবর শুনলেই ব্যাগ গুছিয়ে গ্রামের পথে নেমে পড়েন। তারা মনে করেন, কাজ বন্ধ থাকলে গ্রামে গেলে খেয়ে না খেয়ে থাকা যায়; বাসাভাড়া দেয়ার চাপ থাকে না। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা পথে নেমেই পড়েন ভোগান্তিতে। একশ’ টাকার ভাড়া ৫শ’ টাকা দিতে বাধ্য হন। গতকাল রাজধানী থেকে বের হওয়া এবং প্রবেশ পথগুলোতে এ চিত্র দেখা গেছে।

জানতে চাইলে ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘লকডাউন বলেন আর শাটডাউনবলেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে রক্ষা পেতে এটাকে কার্যকর করতে হবে। লকডাউন তথা বিধিনিষেধ সর্বাত্মকভাবে পালনের নামই শাটডাউন। করোনা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে লকডাউনের বিকল্প নেই। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে না পারলে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় দেশের করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ১৪ দিন শাটডাউন ঘোষণার পরামর্শ দেয়। অতঃপর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা দেন, সোমবার থেকে লকডাউন দেয়া হবে। ২৫ জুন তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য অফিসার সুরথ কুমার সরকার জানান, সোমবার থেকে লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়। অতঃপর ২৪ ঘণ্টা পর ঘোষণা দেয়া হয় ২৮ জুন সোমবার থেকে ‘সীমিত পরিসরে’ এবং আগামী ১ জুলাই থেকে ৭ দিন সারা দেশে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ হবে। প্রশ্ন উঠেছে, সোমবার থেকে সীমিত পরিসরে লকডাউন হলে এতদিন কী ছিল? গত ১৫ মাস থেকে সীমিত পরিসরে লকডাউনের কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দুই সিটে এক যাত্রী থিওরিতে গণপরিবহনে দ্বিগুণ ভাড়া গুনছেন যাত্রীরা। সর্বশেষ ১৬ জুন জারি করা ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ ১৫ জুলাই পর্যন্ত বলবৎ থাকার কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের বিধিনিষেধ জারি আছে, পাশাপাশি ১ জুলাই থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। অবশ্য গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারী করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয় ২৮ জুন সোমবার থেকে সারা দেশে পণ্যবাহী যানবাহন ও রিকশা ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকবে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে এক গবেষণা জরিপে বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩১ শতাংশ পরিবারে ঋণ বেড়ে গেছে। সিপিডি, টিআইবিসহ অনেকগুলো সংস্থা জরিপ করে জানিয়েছে করোনার লকডাউনে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকেই টাকার অভাবে দৈনিক তিন বেলার বদলে দুবেলা খাচ্ছেন। কেউ বাসাভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় ঢাকা ছেড়েছেন। কেউ ঋণ করে খাচ্ছেন, সংসার চালাচ্ছেন। কেউ জমানো পুঁজি ভাঙছেন। কেউ বা স্ত্রী-সন্তান গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে মেসবাড়িতে উঠছেন। এই যখন মানুষের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, তখন লকডাউনের ঘোষণা শুনলেই মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটে যায়। সোমবার থেকে ‘লকডাউন’ এই খবরে গত বৃহস্পতিবার থেকে মানুষ গণপরিবহন বন্ধের মধ্যে নানা পন্থায় গ্রামে ছুঁটছেন। এতে বিভিন্ন ফেরিঘাট ও পথে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানান নামের বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন; আবার সে ঘোষণা পরিবর্তন করছেন। লকডাউনের সঙ্গে মানুষের রুটিরুচি এব করোনা থেকে জীবন রক্ষা জড়িত। অথচ এটাকে ছেলেখেলায় পরিণত করা হয়েছে। কোনো আগাম বার্তা নেই, প্রস্তুতি নেই, দুস্থ মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা নেই, শ্রমিক-নিম্নবৃত্ত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা নেই, জনগণ সম্পৃক্ত করার আয়োজন নেই, এমনকি লকডাউন কার্যকরে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেই; নানান নামে দিলাম লকডাউন, আবার পরিবর্তন করলাম এ যেন তামাশা। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে আবার দূতাবাসের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় হাজার হাজার মানুষকে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন জেলায় এবং অঞ্চলে ‘কাগজে লকডাউন লকডাইন খেলা’ চলছে। কর্মজীবী মানুষ রাস্তায় নামছেন, দুর্ভোগে পড়ছেন; রাজধানী থেকে করোনাভাইরাসকে বহন করে হাটবাজারে গিয়ে গ্রামের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

লকডাউন নিয়ে মানুষ কার্যত দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। গত ১৬ জুন মধ্যরাত থেকে ১৫ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বর্ধিত ‘বিধিনিষেধ’-এর প্রজ্ঞাপনে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে খুলে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা উচ্চঝুঁকি সম্পন্ন হওয়ায় জেলা প্রশাসকগণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কারিগরি কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধে বিধি মোতাবেক লকডাউনসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন বলে জানানো হয়। সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত তিনদিন সেটি বলবৎ থাকবে। একইভাবে বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) থেকে কীভাবে কঠোরভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হবেÑ এই তিনদিনে সেই প্রস্তুতিও নেওয়া হবে।

লকডাউন, সীমিত পরিসরে লকডাউনের ঘোষণায় গতকাল রাজধানীর মানুষের মধ্যে ঢাকা ত্যাগের হিড়িক পড়েছিল। এ যেন ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশত্যাগের হিড়িক আর ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের হিড়িকের মতো। যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন গ্রামের পানে। স্ত্রী-শিশু সন্তান নিয়ে, কেউ কোচকাপুটলি হাড়ি-পাতিল নিয়ে ছুটছেন গ্রামে। লকডাউনে রাজধানীতে কাজ নেই, থাকার অবস্থা নেই তাদের। যাত্রাবাড়ি টিটাগাং রোড, যাত্রাবাড়ি থেকে মাওয়া হাইওয়ে, আবদুল্লাহপুর থেকে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল সড়ক, গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জ সড়কে পিঁপড়ার মতো লাইন ধরে ছুটেছে মানুষ। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ মোটরবাইকে, কেউ সিএনজি, কেউ ভ্যান গাড়িতে, কেউ পিকআপ ভ্যানে আবার কেউ মাইক্রোবাসে যাচ্ছেন। এতো মানুষ একসঙ্গে বের হওয়ায় রাজধানী ঢাকা তীব্র যানজটের কবলে পড়ে যায়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালে করোনার প্রথম ঢেউ ঠেকানোর লকডাউনে পুলিশ ‘যা করণীয়’ সবই করেছে। দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনা ও তদারকি, সড়কে অযথা ঘোরাফেরা বন্ধে নজরদারি, অনাহারির বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া, ওষুধ সরবরাহ, রোগী নেওয়া, লাশ দাফনে সহায়তা, মাস্ক বিতরণসহ নানারকম কাজ করেছে। এবার বিধিনিষেধ আরোপ, সীমান্ত জেলাগুলোতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেয়ে গণপরিবহন চালানোর নির্দেশনা দিলেও কোনোটিই মানেনি মানুষ। মানতে নাগরিকদের বাধ্য করতে পুলিশকে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া সরকারের পরস্পর বিরোধ সিদ্ধান্তের কারণেও অনেকেই লকডাউন মানতে চান না। করোনাকালে দেশের চিকিৎসক, নার্সরা যে ভূমিকা পালন করছে; এ জন্য তাদের প্রণোদনা দেয়া উচিত ছিল। সরকারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

বিষদ স্বাদের লকডাউ‌ন সমাচার।

Update Time : ০৩:০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুন ২০২১

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের পাদুর্ভাবে মানুষের যাপিত জীবনে অপরিকল্পিত ও প্রশাসনের সম্বয়হীনতার নানান নামের লকডাউনে বিপর্যস্ত বিভ্রান্ত মানুষ। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ‘বিধিনিষেধ’, ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ ‘সীমিত পরিসরে লকডাউন’, ‘অঞ্চলভিক্তিক লকডাউন’, ‘সারা দেশে লকডাউন’, ‘কঠোর লকডাউন’ ‘শাটডাউন’ নামের সিদ্ধান্তগুলো কর্মজীবী মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর নামে কয়েক মাস থেকে পরিকল্পনাহীন, সমন্বয়হীনতা, সীমান্ত বন্ধ নানান ধরনের বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে; কিন্তু সেসব বিধিনিষেধের কর্মসূচি কার্যকরে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না। দীর্ঘদিন করোনার কারণে এসব বিধিনিষেধে স্বল্প আয়ের মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী, চাকরিজীবীর দুর্দশা বাড়াচ্ছে, পকেটে টান পড়ে গেছে অথচ করোনা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ২৬৮ জন। সংক্রমণের হার ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এটাকে ভয়াবহ চিত্র মনে করছেন। অথচ করোনাভাইরাস ঠেকানোর কর্মসূচির নামে ছেলেখেলা চলছে মাসের পর মাস ধরে।

মূলত করোনা ঠেকানোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে আবার সে সিদ্ধান্তের ঘনঘন পরিবর্তনের ফলে সরকারের কঠোর সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে কর্মজীবী মানুষ রুটিরুজির জন্য একদিকে বেপরোয়া হচ্ছেন, স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই রাস্তায় নামছেন; অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রাস্তায় নামায় গাদাগাদি করে চলাফেরা করায় করোনা আরো বিস্তার ঘটাচ্ছে। করোনার লকডাউন ঘোষণা দেয়া হচ্ছে অথচ দুস্থ ও গরিব মানুষের আর্থিকভাবে সহায়তা করা হচ্ছে না। লকডাউন বাস্তবায়নে সরকারের হার্ডলাইন আর সফটলাইনের ‘লকডাউন’ কর্মসূচির গ্যাঁরাকলে মানুষ পড়ে গেছে। গতকালও চাকরি হারানো, ব্যবসার পুঁজি ভেঙে খাওয়া বিপন্ন মানুষকে দেখা গেছে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটে যেতে। আর আর্থিক কষ্টে থাকা এই গ্রামমুখী মানুষকে পথেঘাটে পড়তে হয় চরম ভোগান্তির মুখে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘শাটডাউন, লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধ-একেক সময় একেক শব্দ ব্যবহারের কারণে নানা দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। একটা কঠোর বিধিনিষেধ চলমান আছে। তাহলে সোমবার থেকে বুধবার আবার সীমিত বলায় জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। ১ জুলাই থেকে যে কঠোর লকডাউন দেওয়া হবে, সেটি যেন আসলেই কঠোর হয়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তবে সিদ্ধান্ত ঘনঘন পরিবর্তন করায় মানুষ আস্থাহীনতায় ভুগছে’।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সোম থেকে বুধবার আমরা কী করবÑ তার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ব্যবসায়ীদের সামনে নেই। সোমবার থেকে লকডাউন শুনে আমরা সব বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেই। কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় কঠোর লকডাউন পেছানোর ঘোষণায় আমরা সংশয়ে রয়েছি। এরই মধ্যে দোকান কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে এখন বিপাকে পড়ে গেছেন অনেক ব্যবসায়ী’।

‘লকডাউন’ শব্দটি শুনলেই আতকে উঠেন পেশাজীবীরা। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মুটে-মজুর, সীমিত আয়ের মধ্যবৃত্ত, বেসরকারি চাকরিজীবী, নিম্নআয়ের মানুষ ‘লকডাউন’ শুনলেই আতঙ্কে পড়ে যান। দিন এনে দিনে খাওয়া এসব মানুষ পথে বের হতে না পারলে বা কাজ করতে না পারলে, ঘরে বসে খাবেন কি? আবার যারা রাজধানী ঢাকায় থাকেন, তাদের পেটের চিন্তার পাশাপাশি রয়েছে বাসাভাড়ার ভয়। ফলে মিডিয়ায় লকডাউন বা বিধিনিষেধের খবর শুনলেই ব্যাগ গুছিয়ে গ্রামের পথে নেমে পড়েন। তারা মনে করেন, কাজ বন্ধ থাকলে গ্রামে গেলে খেয়ে না খেয়ে থাকা যায়; বাসাভাড়া দেয়ার চাপ থাকে না। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা পথে নেমেই পড়েন ভোগান্তিতে। একশ’ টাকার ভাড়া ৫শ’ টাকা দিতে বাধ্য হন। গতকাল রাজধানী থেকে বের হওয়া এবং প্রবেশ পথগুলোতে এ চিত্র দেখা গেছে।

জানতে চাইলে ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘লকডাউন বলেন আর শাটডাউনবলেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে রক্ষা পেতে এটাকে কার্যকর করতে হবে। লকডাউন তথা বিধিনিষেধ সর্বাত্মকভাবে পালনের নামই শাটডাউন। করোনা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে লকডাউনের বিকল্প নেই। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে না পারলে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় দেশের করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ১৪ দিন শাটডাউন ঘোষণার পরামর্শ দেয়। অতঃপর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ঘোষণা দেন, সোমবার থেকে লকডাউন দেয়া হবে। ২৫ জুন তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য অফিসার সুরথ কুমার সরকার জানান, সোমবার থেকে লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়। অতঃপর ২৪ ঘণ্টা পর ঘোষণা দেয়া হয় ২৮ জুন সোমবার থেকে ‘সীমিত পরিসরে’ এবং আগামী ১ জুলাই থেকে ৭ দিন সারা দেশে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ হবে। প্রশ্ন উঠেছে, সোমবার থেকে সীমিত পরিসরে লকডাউন হলে এতদিন কী ছিল? গত ১৫ মাস থেকে সীমিত পরিসরে লকডাউনের কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দুই সিটে এক যাত্রী থিওরিতে গণপরিবহনে দ্বিগুণ ভাড়া গুনছেন যাত্রীরা। সর্বশেষ ১৬ জুন জারি করা ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ ১৫ জুলাই পর্যন্ত বলবৎ থাকার কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের বিধিনিষেধ জারি আছে, পাশাপাশি ১ জুলাই থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। অবশ্য গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারী করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয় ২৮ জুন সোমবার থেকে সারা দেশে পণ্যবাহী যানবাহন ও রিকশা ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকবে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, ইউএন উইমেন বাংলাদেশ ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি যৌথভাবে এক গবেষণা জরিপে বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক আয় কমেছে। ৩১ শতাংশ পরিবারে ঋণ বেড়ে গেছে। সিপিডি, টিআইবিসহ অনেকগুলো সংস্থা জরিপ করে জানিয়েছে করোনার লকডাউনে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকেই টাকার অভাবে দৈনিক তিন বেলার বদলে দুবেলা খাচ্ছেন। কেউ বাসাভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় ঢাকা ছেড়েছেন। কেউ ঋণ করে খাচ্ছেন, সংসার চালাচ্ছেন। কেউ জমানো পুঁজি ভাঙছেন। কেউ বা স্ত্রী-সন্তান গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে মেসবাড়িতে উঠছেন। এই যখন মানুষের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, তখন লকডাউনের ঘোষণা শুনলেই মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে ছুটে যায়। সোমবার থেকে ‘লকডাউন’ এই খবরে গত বৃহস্পতিবার থেকে মানুষ গণপরিবহন বন্ধের মধ্যে নানা পন্থায় গ্রামে ছুঁটছেন। এতে বিভিন্ন ফেরিঘাট ও পথে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানান নামের বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন; আবার সে ঘোষণা পরিবর্তন করছেন। লকডাউনের সঙ্গে মানুষের রুটিরুচি এব করোনা থেকে জীবন রক্ষা জড়িত। অথচ এটাকে ছেলেখেলায় পরিণত করা হয়েছে। কোনো আগাম বার্তা নেই, প্রস্তুতি নেই, দুস্থ মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তা নেই, শ্রমিক-নিম্নবৃত্ত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা নেই, জনগণ সম্পৃক্ত করার আয়োজন নেই, এমনকি লকডাউন কার্যকরে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেই; নানান নামে দিলাম লকডাউন, আবার পরিবর্তন করলাম এ যেন তামাশা। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে আবার দূতাবাসের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় হাজার হাজার মানুষকে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন জেলায় এবং অঞ্চলে ‘কাগজে লকডাউন লকডাইন খেলা’ চলছে। কর্মজীবী মানুষ রাস্তায় নামছেন, দুর্ভোগে পড়ছেন; রাজধানী থেকে করোনাভাইরাসকে বহন করে হাটবাজারে গিয়ে গ্রামের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

লকডাউন নিয়ে মানুষ কার্যত দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। গত ১৬ জুন মধ্যরাত থেকে ১৫ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বর্ধিত ‘বিধিনিষেধ’-এর প্রজ্ঞাপনে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে খুলে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা উচ্চঝুঁকি সম্পন্ন হওয়ায় জেলা প্রশাসকগণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কারিগরি কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধে বিধি মোতাবেক লকডাউনসহ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন বলে জানানো হয়। সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত তিনদিন সেটি বলবৎ থাকবে। একইভাবে বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) থেকে কীভাবে কঠোরভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করা হবেÑ এই তিনদিনে সেই প্রস্তুতিও নেওয়া হবে।

লকডাউন, সীমিত পরিসরে লকডাউনের ঘোষণায় গতকাল রাজধানীর মানুষের মধ্যে ঢাকা ত্যাগের হিড়িক পড়েছিল। এ যেন ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশত্যাগের হিড়িক আর ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের হিড়িকের মতো। যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন গ্রামের পানে। স্ত্রী-শিশু সন্তান নিয়ে, কেউ কোচকাপুটলি হাড়ি-পাতিল নিয়ে ছুটছেন গ্রামে। লকডাউনে রাজধানীতে কাজ নেই, থাকার অবস্থা নেই তাদের। যাত্রাবাড়ি টিটাগাং রোড, যাত্রাবাড়ি থেকে মাওয়া হাইওয়ে, আবদুল্লাহপুর থেকে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল সড়ক, গাবতলী থেকে মানিকগঞ্জ সড়কে পিঁপড়ার মতো লাইন ধরে ছুটেছে মানুষ। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ মোটরবাইকে, কেউ সিএনজি, কেউ ভ্যান গাড়িতে, কেউ পিকআপ ভ্যানে আবার কেউ মাইক্রোবাসে যাচ্ছেন। এতো মানুষ একসঙ্গে বের হওয়ায় রাজধানী ঢাকা তীব্র যানজটের কবলে পড়ে যায়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালে করোনার প্রথম ঢেউ ঠেকানোর লকডাউনে পুলিশ ‘যা করণীয়’ সবই করেছে। দোকানপাট বন্ধের নির্দেশনা ও তদারকি, সড়কে অযথা ঘোরাফেরা বন্ধে নজরদারি, অনাহারির বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া, ওষুধ সরবরাহ, রোগী নেওয়া, লাশ দাফনে সহায়তা, মাস্ক বিতরণসহ নানারকম কাজ করেছে। এবার বিধিনিষেধ আরোপ, সীমান্ত জেলাগুলোতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং স্বাস্থ্যবিধি মেয়ে গণপরিবহন চালানোর নির্দেশনা দিলেও কোনোটিই মানেনি মানুষ। মানতে নাগরিকদের বাধ্য করতে পুলিশকে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া সরকারের পরস্পর বিরোধ সিদ্ধান্তের কারণেও অনেকেই লকডাউন মানতে চান না। করোনাকালে দেশের চিকিৎসক, নার্সরা যে ভূমিকা পালন করছে; এ জন্য তাদের প্রণোদনা দেয়া উচিত ছিল। সরকারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।