ভুক্তভোগীর পুরো নাম এখানে ব্যবহার করা হয়নি৷
আফ্রিকা মহাদেশের আর পাঁচটা মেয়ের তুলনায় সারাহ অনেকটা ভাগ্যবান৷ আফ্রিকার অনেক দেশেই প্রথা অনুযায়ী মেয়েদের লিঙ্গচ্ছেদ করা হয়৷ সারাহর তা করতে হয়নি৷
কিন্তু বিয়ের পর তার শ্বাশুড়ি যখন তার লিঙ্গচ্ছেদ না করানোর বিষয়টি জানতে পারেন তখনই শুরু হয় পারিবারিক কলহ৷
জোরপূর্বক তার লিঙ্গচ্ছেদ করা হতে পারে এমন আশঙ্কায় বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিতে চাইলেন সারাহ৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাবাও তাকে আশ্রয় দেননি৷ ফিরে আসলেন শ্বশুরবাড়িতে৷ আর সেখানে তার উপর চলতে থাকে ভয়াবহ নির্যাতন৷
নির্যাতনের মুখে একসময় সেখান থেকে পালিয়ে তিনি দেশটির মালি সীমান্তের নিকটবর্তী পোগো শহরে নিজের বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন৷
সারাহ কয়েক মাস সেখানে কাটানোর পর মালির একটি সুপারমার্কেটে কাজ শুরু করেন৷ কিন্তু সেখানেও খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থা না পাওয়ায় তিনি আলজেরিয়া হয়ে লিবিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
‘‘সারা রাত হেঁটে লিবিয়া সীমান্তে পৌঁছাই৷ আমার পা জ্বলছিল, আঙ্গুল দিয়ে রক্ত পড়ছিল৷ মনে হচ্ছিল আমি আগুনের উপর দিয়ে হাঁটছি৷ আমার সাথে আরো কয়েকজন মেয়ে ছিলেন৷ লিবিয়াতে পৌঁছার পর আমার সাথের কয়েকজন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হন৷ ভাগ্যবান ছিলাম, সে যাত্রায় আমি বেঁচে যাই৷’’
সীমান্ত থেকে গাড়িতে করে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে পৌঁছান সারাহ ও তার সাথে থাকা অন্যরা৷ অচেনা দেশটিতে এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন৷ তারপর সেখান থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে ত্রিপোলির পার্শ্ববর্তী তাজোরা জেলে আটক রাখা হয় তাদের৷ লিবিয়ার একটি আটককেন্দ্রে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা৷ ফাইল ছবি
‘সবার সামনেই আমাদের ধর্ষণ করে’
‘‘যাত্রাপথে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলেও লিবিয়া পৌঁছার পর আর নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি,’’ বললেন সারাহ৷
আরো অনেক নাইজেরিয়ান পরিবারের সাথে সারাহ একটি কক্ষে ঘুমাতেন৷ খাবার বলতে দেওয়া হতো রুটি আর স্পাগেটি৷
সারাহ জানান, সেকানকার নিরাপত্তারক্ষীরা প্রতিদিন দুইজন নারীকে ধর্ষণ করতেন৷
নিজেকে বাঁচাতে মেট্রেসের নিচে লুকিয়ে থাকতেন সারাহ৷ কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার৷
‘‘একদিন আমার পালা এল৷ নিজেকে বাঁচাতে দরজা আকঁড়ে ধরলাম, চিৎকার করতে লাগলাম৷ এসময় তারা আমাকে আঘাত করে থামিয়ে দেয়৷’’
সারাহ বলেন, ‘‘তারা আমাকে জোর করে একটি রুমে নিয়ে গেল৷ তাদেরকে ঠেকাতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম৷ তখন তারা শরীরে আঘাত করে আমাকে থামিয়ে দিল৷ আমাকে ধর্ষণ করে আবার রুমে নিয়ে এল৷ প্রতিরাতেই আমাদের সাথে এমন ঘটনা ঘটতে থাকল৷’’
তাজোরার এ কয়েদখানাটিতে সপ্তাহে একদিন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার সদস্যরা আসতেন৷ এখানে আটকে থাকাদের খাবার সরবরাহ করতে আসতেন তারা৷ সারাহ ভাবলেন নির্যাতনের বিষয়টি তাদেরকে জানানো উচিত, কিন্তু ব্যর্থ হলেন৷
‘‘শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার সদস্যদের বিষয়টি জানাতে পারিনি, কারণ নিরাপত্তারক্ষীরা আমাদের রুম থেকে বের হতে দিত না৷’’
আটক নারীদের উপর শারীরিক নির্যাতনের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল৷ আর তা যে কতটা ভয়াবহ রুপ নিচ্ছিল তা সারাহর কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠে৷
‘‘এক পর্যাযে নিরাপত্তারক্ষীরা আমাদের অন্য রুমে নিয়ে যেতেও চাইত না৷ যে রুমে আমরা থাকি সে রুমেই তারা আমাদের ধর্ষণ করতো, সবার সামনেই!’’
‘গর্ভবতী হয়ে পড়লাম’
সারাহ জানান, একদিন তাদের সাথে আটক থাকা এক নারী বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন৷ তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল৷ যন্ত্রণায় সে তার পাশে থাকা অন্য নারীদের জাপটে ধরছিল৷ আতংকিত সারাহ দূর থেকে দেখছিলেন পুরো বিষয়টি৷
‘‘আমি রক্ত দেখে ভয় পাই৷ আর তাই কাছে যাইনি৷ জড়োসড়ো হয়ে দূরেই বসে রইলাম৷ আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিল৷’’
তিনি জানান, এ নারীটিকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললে নিরাপত্তারক্ষীদের একজন বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখায়৷ কয়েক ঘণ্টা পর তারা ওই নারীর মরদেহ এখান থেকে সরিয়ে নেয়৷
এই ঘটনার পর কয়েকদিন নির্যাতন বন্ধ ছিল৷ তবে তা বেশিদিন নয়, বললেন সারাহ৷
‘‘তারপর একদিন আমার পালা এল৷ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমার শরীরে কোনো শক্তি নেই৷ আমি বাধাও দিতে পারলাম না, চিৎকারও না৷ কারণ আমার সে শক্তি ছিল না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘একদিন দেখলাম আমার পেট ফুলে উঠছে৷ আর তা বাড়ছেই৷ বুঝলাম, আমি গর্ভবতী৷ যখন বিষয়টি বুঝতে পারলাম, তখন আমি আর সইতে পারছিলাম না৷ কারণ আমিতো এভাবে বাচ্চা চাইনি৷’’
এমন পরিস্থিতিতে অসহায় সারাহ কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷ শারীরিক ও মানিসক যন্ত্রণা সারাহকে কুরে কুরে খাচ্ছিল৷
‘‘আমি আমার পেটে আঘাত করতে লাগলাম৷ এ বাচ্চা আমি চাই না৷ আমি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলাম৷ আর এমন করছিলাম কারণ আমি চাইছিলাম, আমার পেটে থাকা বাচ্চাটি যেন মরে যায়৷’’
‘‘তারপর… ! হঠাৎ একদিন আমার প্রসব বেদনা শুরু হলো৷ সেসময় এতো কষ্ট হচ্ছিল যে, আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল৷ সাথে আটক সবাই আমাকে সাহায্যে করার জন্য এগিয়ে আসলেন৷ দিনটি ছিল ২৬ মার্চ ২০২০৷ আমি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলাম৷’’
বাচ্চা জন্মদানের পরপরই আরেকটি ঘটনা ঘটল৷ সারাহ জানান, নিরাপত্তারক্ষীরা দরজা খুলে দিয়ে বলল, তোমরা সবাই চলে যেতে পার৷
‘‘আনন্দে, উৎফুল্ল সবাই দৌড়ে বের হয়ে গেল৷ আমিও বের হয়ে গেলাম৷ বাচ্চাকে ফেলেই বেরিয়ে গেলাম৷ কিন্তু নিরাপত্তারক্ষীরা আমাকে আটক করে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যেতে বললেন৷’’
এর পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে সারাহ বলেন, ‘‘একজন বয়স্ক নারীর সাথে আমি বেরিয়ে গেলাম৷ তারপর একটি ট্যাক্সি ক্যাবে করে ত্রিপোলিতে চলে আসি৷ এখানে অবশ্য অনেক আফ্রিকান আছেন যারা ইংরেজিতে কথা বলেন৷’’
‘নতুন জীবনের’ আশায় ত্রিপোলিতে
‘‘ট্যাক্সি থেকে নামার পর নিজের বাচ্চার কথা ভুলে গিয়েছিলাম,’’ বললেন সারাহ৷
বাচ্চাটিকে আমার সাথে আসা নারীর কাছে রেখেই চলে যেতে চাইলাম৷ কিন্তু সে নারী আমাকে বললেন, ‘‘তুমি যদি এ বাচ্চাটিকে ফেলে যাও তাহলে কেউ তার দেখাশুনা করবে না৷ তারপর আমি বাচ্চাটিকে সাথে নিয়ে আসলাম৷ সারারাত ধরে আমি কাঁদলাম, আর ভাবলাম সৃষ্টিকর্তা আমাকে এটি দিয়েছেন, তাই আমি তাকে ফেলে যেতে পারি না৷’’
বর্তমানে লিবিয়ার জাউয়াতে থাকেন সারাহ৷ প্রায় ৩৫জন নারীর সাথে বড় একটি ঘরে থাকেন তিনি৷ সামাজিক, মানসিক চাপে ক্লিষ্ট সারাহ মাঝে মাঝে এখান থেকে চলে যাবার কথাও ভাবেন৷
‘‘আগে এ জায়গা থেকে চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করতাম না৷ কিন্তু এখন ভাবছি৷ সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে চাই৷ একটা নৌকায় করে এখান থেকে চলে যেতে চাই, যত টাকাই লাগুক৷’’
এখানে একটি নৌকা ভাড়া করে বেরিয়ে যেতে চাইলে এক-দেড় লাখ টাকা লাগবে৷ সারাহর কাছে এই মুহূর্তে টাকা নেই, তবে তিনি চলে যেতে চান৷ আর তাই সব কিছুই ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়েছেন নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা অসহায় সারাহ৷
‘‘মাঝে মাঝে গোসলখানায় গিয়ে কাঁদি৷ আইভরি কোস্টে আর ফিরে যেতে চাই না৷ সেখানে যে নির্যাতন আমি সহ্য করেছি তার চেয়ে লিবিয়াতেই মরতে চাই৷’’
মারলেনে পানারা/আরআর