০৯:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

৯০ শতাংশ গ্যারেজেই অবৈধ বিদ্যুৎ তিন চাকার অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ করা হয়

  • Reporter Name
  • Update Time : ০১:০০:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২
  • 20

ব্যাটারিচালিত তিন চাকার ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ। এ ধরনের অবৈধ যানবাহনে ছেয়ে গেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামের হাটবাজারের অলিগলি। এসব অবৈধ যানবাহন ব্যাটারির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং সেই ব্যাটারি কয়েক ঘণ্টা পর পর চার্জ দিতে হয়। রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় প্রতিটি রিকশা গ্যারেজেই নিষিদ্ধ এসব অটোবাইক ও রিকশার ব্যাটারি চার্জ করা হয়। সবগুলোতেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মরত একশ্রেণির অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই সব অবৈধ সংযোগ দেন অর্থের বিনিময়ে। ফলে প্রতিদিন উৎপাদিত বিদ্যুতের একটা বড় অংশ গিলে খাচ্ছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার ইজিবাইক।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশায় বিদ্যুৎ বন্ধে কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি। করা হবে কি না এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক জনসংযোগ পরিদপ্তর মো. আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের যারা গ্রাহক তারা সংযোগ লাইন এবং নিজেদের মিটার ব্যবহার করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেন। আবার যারা অবৈধভাবে চার্জ দিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে এসব বন্ধে এখনো কোনো দির্দেশনা আসেনি। জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চার চাকার ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের খরচ হচ্ছে। সাধারণত একটি ইজিবাইক চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে এক লাখ ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১১০ মেগাওয়াট এবং মাসে ৩৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু ৮০ ভাগ গ্যারেজ চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব ব্যাটারি রিচার্জ করায় সরকার প্রায় ২৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কয়েক লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার ইজিবাইক চলাচল করছে।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, শুধু রাজধানী ঢাকার আশপাশ নয়; সারাদেশে এই অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ দেয়া হয়। সারাদেশে জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম প্রধান কারণ নিষিদ্ধ ইজিবাইক বা অটোরিকশা বন্ধ করা উচিত বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। তবু চলছে এই বাহনটি। এর সংখ্যা গুণে শেষ করা মুশকিল। নিয়মের বালাই নেই পরোয়াও নেই। দেশের ৯০ শতাংশ গ্যারেজেই নিষিদ্ধ এসব অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন। অনেক স্থানে চলছে মিটার টেম্পারিংয়ের মতো ঘটনা। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন করে ইজিবাইক আমদানি বন্ধ ও পুরনোগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে নেয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি গত কয়েক বছরেও। মহাসড়কগুলোতে এই যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, নামধারী সাংবাদিক, ডিপিডিসি, পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ, জেলা ট্রাফিক বিভাগ ও হাইওয়ে পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই রাস্তায় চলছে অটোরিকশা। এসব অটোরিকশার পেছনে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতের সংযোগের মাধ্যমে সারাদেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চার্জ দেয়া হচ্ছে বেশি বলে জানা গেছে। এদিকে সারাদেশে অটোরিকশা কি পরিমাণ বিদ্যুৎ খাচ্ছে তার সঠিক তথ্য বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর কাছে নেই বলে জানা গেছে।

বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে সরকার দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং শুরু করেছে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে মসজিদগুলোতে নামাজের সময় ছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি অফিসে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম প্রধান ইজিবাইক বা অটোরিকশা বন্ধ থামছে না। এখনো এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি। দেশজুড়ে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য।

হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কিছু অসাধু ব্যক্তি ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবসা করে যাচ্ছে। ব্যাটারিচালিত সে রিকশা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানী ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে যাত্রী বহন করে চলছে। আর প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়ে এর গতি বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার শিকার অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এতে অনেক পরিবারই নিঃস্ব হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বরং দিন দিন এসব যানের সংখ্যা বাড়ছেই। দেশের ৮ বিভাগের মহানগরীর সব শহবে একই পথে ব্যাটারির রিকশা চলাচল করায় রাজধানী শহর এই অবৈধ রিকশার দখলে চলে গেছে।
জেলা প্রশাসন বা ট্রাফিক বিভাগের কাছে সংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলায় বর্তমানে কমপক্ষে ৫০ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলাচল করছে। বিশেষ করে ব্যস্ত নগরী নারায়ণগঞ্জ, শিল্পাঞ্চল ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর এলাকায় এর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩০ হাজারের মতো।

পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি রিকশার ব্যাটারি চার্জে এক কিলোওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ ব্যয় হয়। সেই হিসাবে ৫০০ রিকশার পেছনে প্রায় ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে। পৌর এলাকার জন্য গরমের সময় তিন ও শীতের সময় দুই মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বর্তমানে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও এর প্রায় এক-চতুর্থাংশই ব্যয় হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশার পেছনে। রিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গ্যারেজ। এসব গ্যারেজে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো চার্জ দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। গ্যারেজের মালিকেরা প্রতিটি রিকশা চার্জ দেয়ার জন্য দৈনিক ৪০ টাকা নিয়ে থাকেন। নিয়মানুযায়ী গ্যারেজগুলোতে বাণিজ্যিক মিটার থাকার কথা। কিন্তু গ্যারেজের মালিকেরা বাড়ির পাশে গ্যারেজ গড়ে তুলে বাড়ির মিটারের সংযোগ থেকেই ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক নিজের বাড়িতে অথবা গরিব কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বাড়িতে রাতব্যাপী রিকশার ব্যাটারিগুলো চার্জ দিচ্ছেন।

বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্বের বহু দেশের গাড়ি এখন বিদ্যুতে চলে। ২০৩০ সালের পর কনভার্সন ইঞ্জিন অথবা তেল বা গ্যাস পুড়িয়ে যে আমরা চলি সেটি থাকবে না বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, সিএনজির তুলনায় জ্বালানি তেলচালিত গাড়ির দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। সিএনজিতে একেবারে ক্ষতি হয় না, সেটি বলা উচিত না। কিন্তু তেলের তুলনায় সেটা কিছুই না। এর চেয়েও বেশি ভালো হয় হাইব্রিড গাড়ি অথবা বিদ্যুৎচালিত গাড়ি। এই দুই ধরনের গাড়ি থেকে পরিবেশের কোনো ক্ষতিই হয় না। এতে অনেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।

খুলনা নগরের কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা নেই। যে সামান্য কয়েকটি রিকশা দেখা গেছে, সেগুলোর ব্যাটারি ও মোটর খুলে রাখা হয়েছে। রিকশা না থাকায় নগরের গলির সড়কগুলো থেকে মানুষ হেঁটে প্রধান সড়কে গিয়ে ইজিবাইক ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সমস্যা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তারপরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করতে দেয়ার দাবি জানাননি কেউই। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ইয়াসমিন হোসেন নামের এক অভিভাবককে দেখা যায় নিরালা এলাকা থেকে স্কুল ড্রেস পরা মেয়েকে নিয়ে হেঁটে প্রধান সড়কের দিকে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই হেঁটেই যাচ্ছেন। রিকশা বন্ধ থাকবে তা আগে জানতে পারলে ভালো হতো। ব্যাটারিচালিত রিকশা ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে ভেতরের অলিগলিতে চলাচলের জন্য বিকল্প যানবাহন থাকতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ থাকার ব্যাপারটিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নগরের অনেকেই। ভোগান্তির কথা খুব বেশি উচ্চারিত না হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বন্ধ থাকার পক্ষে মতামত দিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পর্কে আজমুল মৃধা নামের একজন লিখেছেন, সড়কের বুক চিরে যেন প্লেন চলত এত দিন। খান হারুন নামের একজন লিখেছেন, ‘খুলনাকে এমন পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে দেখতে চাই আমরা।’ তবে কোনো কোনো মন্তব্যে চালকদের মানবিক দিকও তুলে ধরা হয়েছে।

নগরে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বন্ধ করতে গত মে মাস থেকেই পদক্ষেপ নিয়েছেন সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। ওই সময় তাঁর দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী গত বছর ১ জুলাই থেকে নগরের মধ্যে রিকশার চলাচল বন্ধ হওয়ার কথা। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে নগরে মাইকিংও করা হয়। ওই নিষেধাজ্ঞা পেয়ে অনেকেই চার্জিং পয়েন্ট গুটিয়ে নেন। কিন্তু জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় সব কাউন্সিলর ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের জন্য আরো তিন মাসের সময় চান। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞা আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। বর্ধিত ওই ১৫ দিনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ। নগরে চলাচলের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ১৭ হাজারের মতো পায়েচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে নগরে কোনো পায়ে চালানো রিকশা দেখা যায় না। সব রিকশাতেই ব্যাটারি ও মোটর লাগিয়ে অটোরিকশায় পরিণত করা হয়েছে। নগরের মধ্যে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে বলে মনে করেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

৯০ শতাংশ গ্যারেজেই অবৈধ বিদ্যুৎ তিন চাকার অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ করা হয়

Update Time : ০১:০০:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২

ব্যাটারিচালিত তিন চাকার ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ। এ ধরনের অবৈধ যানবাহনে ছেয়ে গেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামের হাটবাজারের অলিগলি। এসব অবৈধ যানবাহন ব্যাটারির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং সেই ব্যাটারি কয়েক ঘণ্টা পর পর চার্জ দিতে হয়। রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় প্রতিটি রিকশা গ্যারেজেই নিষিদ্ধ এসব অটোবাইক ও রিকশার ব্যাটারি চার্জ করা হয়। সবগুলোতেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মরত একশ্রেণির অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই সব অবৈধ সংযোগ দেন অর্থের বিনিময়ে। ফলে প্রতিদিন উৎপাদিত বিদ্যুতের একটা বড় অংশ গিলে খাচ্ছে এই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার ইজিবাইক।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশায় বিদ্যুৎ বন্ধে কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি। করা হবে কি না এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক জনসংযোগ পরিদপ্তর মো. আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের যারা গ্রাহক তারা সংযোগ লাইন এবং নিজেদের মিটার ব্যবহার করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেন। আবার যারা অবৈধভাবে চার্জ দিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। তবে এসব বন্ধে এখনো কোনো দির্দেশনা আসেনি। জানা গেছে, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও চার চাকার ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের খরচ হচ্ছে। সাধারণত একটি ইজিবাইক চালানোর জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৯০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে এক লাখ ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১১০ মেগাওয়াট এবং মাসে ৩৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু ৮০ ভাগ গ্যারেজ চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব ব্যাটারি রিচার্জ করায় সরকার প্রায় ২৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কয়েক লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার ইজিবাইক চলাচল করছে।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, শুধু রাজধানী ঢাকার আশপাশ নয়; সারাদেশে এই অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও তিন চাকার অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ দেয়া হয়। সারাদেশে জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম প্রধান কারণ নিষিদ্ধ ইজিবাইক বা অটোরিকশা বন্ধ করা উচিত বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। তবু চলছে এই বাহনটি। এর সংখ্যা গুণে শেষ করা মুশকিল। নিয়মের বালাই নেই পরোয়াও নেই। দেশের ৯০ শতাংশ গ্যারেজেই নিষিদ্ধ এসব অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন। অনেক স্থানে চলছে মিটার টেম্পারিংয়ের মতো ঘটনা। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন করে ইজিবাইক আমদানি বন্ধ ও পুরনোগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে নেয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকর হয়নি গত কয়েক বছরেও। মহাসড়কগুলোতে এই যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, নামধারী সাংবাদিক, ডিপিডিসি, পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ, জেলা ট্রাফিক বিভাগ ও হাইওয়ে পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই রাস্তায় চলছে অটোরিকশা। এসব অটোরিকশার পেছনে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতের সংযোগের মাধ্যমে সারাদেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চার্জ দেয়া হচ্ছে বেশি বলে জানা গেছে। এদিকে সারাদেশে অটোরিকশা কি পরিমাণ বিদ্যুৎ খাচ্ছে তার সঠিক তথ্য বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর কাছে নেই বলে জানা গেছে।

বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে সরকার দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং শুরু করেছে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে মসজিদগুলোতে নামাজের সময় ছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি অফিসে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ চুরির অন্যতম প্রধান ইজিবাইক বা অটোরিকশা বন্ধ থামছে না। এখনো এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি। দেশজুড়ে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য।

হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে কিছু অসাধু ব্যক্তি ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যবসা করে যাচ্ছে। ব্যাটারিচালিত সে রিকশা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানী ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে যাত্রী বহন করে চলছে। আর প্যাডেলচালিত রিকশার চেয়ে এর গতি বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার শিকার অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। এতে অনেক পরিবারই নিঃস্ব হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বরং দিন দিন এসব যানের সংখ্যা বাড়ছেই। দেশের ৮ বিভাগের মহানগরীর সব শহবে একই পথে ব্যাটারির রিকশা চলাচল করায় রাজধানী শহর এই অবৈধ রিকশার দখলে চলে গেছে।
জেলা প্রশাসন বা ট্রাফিক বিভাগের কাছে সংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলায় বর্তমানে কমপক্ষে ৫০ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলাচল করছে। বিশেষ করে ব্যস্ত নগরী নারায়ণগঞ্জ, শিল্পাঞ্চল ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর এলাকায় এর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩০ হাজারের মতো।

পাবনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি রিকশার ব্যাটারি চার্জে এক কিলোওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ ব্যয় হয়। সেই হিসাবে ৫০০ রিকশার পেছনে প্রায় ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে। পৌর এলাকার জন্য গরমের সময় তিন ও শীতের সময় দুই মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বর্তমানে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেলেও এর প্রায় এক-চতুর্থাংশই ব্যয় হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশার পেছনে। রিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গ্যারেজ। এসব গ্যারেজে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো চার্জ দেয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। গ্যারেজের মালিকেরা প্রতিটি রিকশা চার্জ দেয়ার জন্য দৈনিক ৪০ টাকা নিয়ে থাকেন। নিয়মানুযায়ী গ্যারেজগুলোতে বাণিজ্যিক মিটার থাকার কথা। কিন্তু গ্যারেজের মালিকেরা বাড়ির পাশে গ্যারেজ গড়ে তুলে বাড়ির মিটারের সংযোগ থেকেই ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক নিজের বাড়িতে অথবা গরিব কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বাড়িতে রাতব্যাপী রিকশার ব্যাটারিগুলো চার্জ দিচ্ছেন।

বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্বের বহু দেশের গাড়ি এখন বিদ্যুতে চলে। ২০৩০ সালের পর কনভার্সন ইঞ্জিন অথবা তেল বা গ্যাস পুড়িয়ে যে আমরা চলি সেটি থাকবে না বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, সিএনজির তুলনায় জ্বালানি তেলচালিত গাড়ির দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। সিএনজিতে একেবারে ক্ষতি হয় না, সেটি বলা উচিত না। কিন্তু তেলের তুলনায় সেটা কিছুই না। এর চেয়েও বেশি ভালো হয় হাইব্রিড গাড়ি অথবা বিদ্যুৎচালিত গাড়ি। এই দুই ধরনের গাড়ি থেকে পরিবেশের কোনো ক্ষতিই হয় না। এতে অনেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।

খুলনা নগরের কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা নেই। যে সামান্য কয়েকটি রিকশা দেখা গেছে, সেগুলোর ব্যাটারি ও মোটর খুলে রাখা হয়েছে। রিকশা না থাকায় নগরের গলির সড়কগুলো থেকে মানুষ হেঁটে প্রধান সড়কে গিয়ে ইজিবাইক ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সমস্যা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তারপরও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করতে দেয়ার দাবি জানাননি কেউই। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ইয়াসমিন হোসেন নামের এক অভিভাবককে দেখা যায় নিরালা এলাকা থেকে স্কুল ড্রেস পরা মেয়েকে নিয়ে হেঁটে প্রধান সড়কের দিকে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই হেঁটেই যাচ্ছেন। রিকশা বন্ধ থাকবে তা আগে জানতে পারলে ভালো হতো। ব্যাটারিচালিত রিকশা ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে ভেতরের অলিগলিতে চলাচলের জন্য বিকল্প যানবাহন থাকতে হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ থাকার ব্যাপারটিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নগরের অনেকেই। ভোগান্তির কথা খুব বেশি উচ্চারিত না হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বন্ধ থাকার পক্ষে মতামত দিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। ব্যাটারিচালিত রিকশা সম্পর্কে আজমুল মৃধা নামের একজন লিখেছেন, সড়কের বুক চিরে যেন প্লেন চলত এত দিন। খান হারুন নামের একজন লিখেছেন, ‘খুলনাকে এমন পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে দেখতে চাই আমরা।’ তবে কোনো কোনো মন্তব্যে চালকদের মানবিক দিকও তুলে ধরা হয়েছে।

নগরে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বন্ধ করতে গত মে মাস থেকেই পদক্ষেপ নিয়েছেন সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। ওই সময় তাঁর দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী গত বছর ১ জুলাই থেকে নগরের মধ্যে রিকশার চলাচল বন্ধ হওয়ার কথা। ওই নির্দেশনা বাস্তবায়নে নগরে মাইকিংও করা হয়। ওই নিষেধাজ্ঞা পেয়ে অনেকেই চার্জিং পয়েন্ট গুটিয়ে নেন। কিন্তু জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় সব কাউন্সিলর ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের জন্য আরো তিন মাসের সময় চান। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞা আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। বর্ধিত ওই ১৫ দিনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ। নগরে চলাচলের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে ১৭ হাজারের মতো পায়েচালিত রিকশার লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে নগরে কোনো পায়ে চালানো রিকশা দেখা যায় না। সব রিকশাতেই ব্যাটারি ও মোটর লাগিয়ে অটোরিকশায় পরিণত করা হয়েছে। নগরের মধ্যে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজারের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে বলে মনে করেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।