৯ নং ওয়ার্ডের আঃলীগ বিদ্রোহী প্রার্থী জসিমের অবৈধ সম্পদের পাহাড়।

চট্টগ্রাম থেকে নিজেস্ব প্রতিনিধি তাপস বোসঃ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কিশোর অপরাধী চক্রের (কিশোর গ্যাং) ৪৮ জন পৃষ্ঠপোষক বা নেতার তালিকা করে। তাঁদের মধ্যে সাতজন চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আলোচিত এই সাতজনের মধ্যে দুজন সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থী। বাকি পাঁচজন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। তাঁরা হলেন নূর মোস্তফা ওরফে টিনু, এরসাদুল হক, আবুল হাসনাত ওরফে বেলাল, দিদারুল আলম মাসুম, সাবের আহম্মদ, জহুরুল হক ওরফে জসিম ও ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এর মধ্যে অবশ্য ১২ ও ২৫ নং ওয়ার্ডের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী সাবের আহম্মদ ও এরসাদুল হক তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন।
তবে আলোচিত বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে উত্তর হালিশহর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিমের নাম বেশ উল্লেখযোগ্য। বলা যায় একদম তৃণমূল থেকে উঠে আসা এ নেতা আজকের প্রভাবশালীর উল্লেখযোগ্য অবস্থানে এসে হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। বর্তমানে ৯ নং ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচন করছেন।
সাবেক এ কাউন্সিলর জসিম বর্তমানে ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। ছাত্রজীবনে পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে সন্দ্বীপের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছাত্রদলের ক্যাডার বেলাল উদ্দিন জুয়েলকে আকবর শাহ থানা এলাকার যুবলীগের নেতা বানানোর অভিযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করানো হয় এবং তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এলাকায় নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত।
স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জয়বিডি২৪ কে বলেন, “কাউন্সিলর জসিম দলের নাম ভাঙিয়ে দলের সুনাম নষ্ট করছেন। কাউন্সিলরের পদে থেকেও দখলবাজি, পাহাড় কাটা, জমি দখলসহ নানা অপরাধ করেছেন। এর মাধ্যমে গত চার বছরে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।”
তবে আজকের এ দৃশ্যপটে আসতে হলে ফিরে যেতে হবে ১ যুগ পেছনে, জানা যাবে সাবেক এ কাউন্সিলরের শত শত কোটি টাকার মালিক হবার পেছনের রুপকথার গল্প।
২০০৭ সালে ইস্পাহানি মিলস লিমিটেডে সুপারভাইজার পদে মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন জহুরুল আলম জসিম।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চাকরি ছেড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন জসিম।
২০১৫ সালে ২৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কাউন্সিলর হবার পর জসিম হয়ে উঠেন এলাকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী এক গডফাদার।
এরপর থেকে প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি এলাকায় মাদক কারবার, দখলবাজি, শত শত একর পাহাড় কেটে সরকারি খাস জায়গা অবৈধভাবে বিক্রয়, বিশ্বব্যাংক হাউজিং এস্টেটের কবরস্থান দখল করে জায়গা বিক্রয়, অটোরিকশা-বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায়, কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেটের ১৬০টি দোকানঘর দখলসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন।
সেভেন মার্কেট বাজার, যা কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেটের মালিকানাধীন, সেখানে ১৬০টি দোকান কাউন্সিলর জসিমের দখলে রয়েছে। প্রতিটি দোকানের দখল এককালীন এক লাখ টাকা করে মোট এক কোটি ৬০ লাখ টাকায় হস্তান্তর করেছেন। এসব দোকানের প্রতিটি থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে আদায় হয়। অর্থাৎ মাসে আট থেকে ৯ লাখ টাকা আদায় হয়। সেভেন মার্কেট অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন জসিম। মাসে যার পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ টাকা। জসিম তাঁর কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকায় দখলবাজি, প্রভাব বিস্তার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তার বর্তমান সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরতে গেলে চক্ষু কপালে উঠবে। সরজমিনে প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা যায়, বর্তমানে নামে-বেনামে তাঁর ৩০০-৪০০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক কলোনিতে ১৭টি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা;
ফিরোজ শাহ কলোনিতে ছয়টি প্লট ও দুটি ছয়তলা বাড়ি, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা;
গিরিধারা হাউজিংয়ে সাত কাঠা সমমানের চারটি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১০ কোটি টাকা;
জয়ন্তিকা আবাসিকে ১৩টি প্লট, যার বাজারমূল্য আট থেকে ১০ কোটি টাকা;
লেকসিটি হাউজিংয়ে ছয়টি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা;
লেকসিটি হাউজিংয়ের পাশে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে বিভিন্ন দাগে মোট ২০ কানি (৪০০ গণ্ডা) জায়গা দখল, যার বাজারমূল্য ৮০-৯০ কোটি টাকা;
হারবাতলী শাপলা আবাসিক এলাকায় অন্তত ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি দৃশ্যমান।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পশ্চিম বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) দপ্তরে অভিযোগ রয়েছে ১১৫টি। তাঁর বিরুদ্ধে সিএমপির বিভিন্ন থানায় ২০টির বেশি চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও অস্ত্র মামলা আছে।
২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার একটি মামলায় জসিমকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে। মামলাটি এখন বিচারাধীন।
২০১৯ সালের ৩০ জুন নগরের পাহাড়তলী এলাকায় যুবলীগের প্রতিপক্ষের কর্মী মহসিনকে বেধড়ক পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ঘটনার মূল নায়ক বেলাল উদ্দিন জুয়েলও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর জসিমের অনুসারী।
জানা যায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে দেশজুড়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর গাঢাকা দেন কাউন্সিলর জসিম। ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। সম্প্রতি অভিযান বন্ধ থাকায় আবারও এলাকায় ফিরেছেন তিনি।
তবে এতো এতো অভিযোগে এর বিষয়ে সাবেক এ কাউন্সিলর এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জহুরুল হক ওরফে জসিম তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় পর আমার প্রতিপক্ষের লোকজন এসব মামলা ও অভিযোগ করে আমাকে হেয় করতে চাইছে।’
কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের পক্ষে তাঁর ভাই আকবর হোসেন খোকন এক চিঠিতে দাবি করেছিলেন, জসিমের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে পুলিশ জিডি করেছিল পাহাড়তলী থানায়। এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলা হয়। এগুলো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা। পুলিশ বাদী হওয়া মামলা। এসব মামলায় জসিম খালাস পেয়েছেন। ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কোনো ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। তিনি কোনো দিন জামায়াত-বিএনপিকে সহায়তা করেননি। তিনি সব সময় মাদক, সন্ত্রাস ও সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছেন।
খোকন আরো দাবি করেন, তাঁর ভাই কোনো সম্পত্তি দখল বা সরকারি জমি দখল করেননি। লেকসিটি নামের প্রকল্প করতে সিটি করপোরেশন পাহাড় কর্তন করে, যার সঙ্গে তাঁর ভাই বা তাঁদের পরিবারের সম্পৃক্ততা নেই। সেভেন মার্কেট তিনি দখল করেননি, কাউকে দখল করতেও তিনি বলেননি। রাস্তার কাজ করতে গিয়ে এলাকার বিভিন্ন হকার উচ্ছেদ হলে তারা হাউজিংয়ের পড়ে থাকা খালি জায়গায় শামিয়ানা টানিয়ে দোকান করে, এর থেকে কোনো টাকা তাঁর ভাই নেন না।
কিন্তু উনারা দু ভাই যত কিছুই বলেন না কেন তা মানতে সারাজ আপামর এলাকাবাসী।
এদিকে বিভিন্ন এলাকার কিশোর অপরাধী চক্রের কথিত ‘গডফাদার’ বা ‘বড় ভাইয়েরা’ জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াইয়ে নামায় নির্বাচনের পরিবেশ অশান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে নাগরিক সমাজ।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কশিনার সূত্রে জানা যায়, “কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকেরা নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তাঁরা যাতে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করতে না পারেন, সে জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে। তাঁদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বিন্দুমাত্রও সুযোগ দেওয়া হবে না।”
৯ নং ওযার্ডের সাধারন এলাকাবাসীরা বলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের কাতর অনুরোধ, এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে তাঁকে যেন আইনের আওতায় আনা হয়।