বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অর্থ বাণিজ্য, হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা!

ছবিঃ নগরীর ১১ নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের বাহিরে প্রার্থী ইসমাঈল ও এরশাদুল আমিনের ক্যাডারদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র সস্ত্র কুড়িয়ে নিচ্ছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
সদ্য সমাপ্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনার তুঙ্গে ছিলো আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থীদের লড়াই।
কেন্দ্রের নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দলের ভিতরে থাকা শীর্ষ নেতারাই এসব বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দিয়ে গিয়েছেন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ এমনকি প্রকাশ্যে। আর এসব বিদ্রোহী প্রার্থীদের সকলেই ছিলেন সাবেক মেয়র ও বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারী। তার সাথে ছিলেন চট্টগ্রাম ১০ আসনের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সরকার দলীয় সাংসদ ডা. আফসারুল আমিনের ভাই এরশাদুল আমিন।
নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থীদের দৌড়াত্মে অসহায় ছিলেন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের ব্যক্তিরা।
এবারের চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পুরুষ বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলো ৮৯ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিদ্রোহী ছিলেন ২৬ জন।
এদের মধ্যে পুরুষ ৩ জন এবং মহিলা একজন বিদ্রোহী প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন। বাকি সবাই তারা নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত ছিলেন। পুরুষ ও মহিলা বিদ্রোহী প্রার্থীরা কোন না কোন ভাবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এর রাজনীতির সম্পৃক্ত। কেউ আবার মহানগর ও ওয়ার্ড দলীয় কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট।
সরজমিনে নির্বাচন পরবর্তি সময়ে আ জ ম নাছির ও এরশাদুল আমিন এর কার্যকলাপ বিষয়ে বের হয়ে এসেছে বেশ কিছু তথ্য।
এবারের নির্বাচনে বিদ্রোহী অনেক প্রার্থীরা নিজেদের হারের জন্য দায়ী করছেন তাদের অনুসাারী নেতা আ জ ম নাছির ও এরশাদুল আমিনকে।
হেরে যাওয়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকে ক্ষোভের সাথে বলেন যে তারা তাদের নেতাদের ভরসায় নির্বাচন করেছেন। অনেকে আবার বলছেন তারা তাদের নেতাদের পকেটে মোটা অংকের টাকাও দিয়েছেন।
নির্বাচন পরবর্তি সময়ে বিদ্রোহ প্রার্থী অধ্যুষিত ওয়ার্ডগুলোতে সরজমিনে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, মূলতঃ বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করানোর পিছনে বিদ্রোহীদের সমর্থন জানানো নেতাদের দুরভিসন্ধি ছিলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরাজিত বিদ্রোহী প্রার্থী বলেন, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরশাদুল আমিন কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন ৭ টি ওয়ার্ডের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছ থেকে।
নগরীর ১১ নং ওয়ার্ডের ৪ বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছ থেকে এরশাদুল আমীন নির্বাচনে সুবিধা আদায় করিয়ে দেবার জন্য মোটা অংকের টাকা দাবী করেন। এর মধ্যে এক প্রার্থীর কাছ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা দাবী করেন এরশাদুল আমীন। কিন্তু ১১ নং ওয়ার্ডের কোন বিদ্রোহী প্রার্থী এরশাদুল আমীনের দাবী কৃত অর্থ দিতে অপরাগত জানানো বা দিতে না পারার কারনে এরশাদুল আমীন হাত মেলান দল সমর্থিত প্রার্থি মোঃ ইসমাঈলের সাথে।
ইতিমধ্যে নব নির্বাচিত কাউন্সিলর মোঃ ইসমাঈলের সাথে বিরাট অংকের টাকার লেনদেন হয় এরশাদুল আমীনের। তার ফলস্বরূপ নির্বাচনের পূর্বেই ১১ নং ওয়ার্ডের অন্য চার প্রার্থীর একজন খন্দকার এনামুল হক বাবলুর নির্বাচনী অফিস ভেঙ্গে দেয় এরশাদুল আমীনের পালিত ক্যাডার এবং আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সদস্য মিল্টন এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা। শুধু তাই নয় নির্বাচনের আগেই খন্দকার এনামুল হক বাবলুকে প্রাণনাশের হুমকি-ধমকি দিয়ে কক্সবাজার পাঠিয়ে দেয় এরশাদুল আমিনের সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী।
আরেক প্রার্থী এবং সাবেক কাউন্সিলর মোর্শেদ আকতার চৌধুরীকে নির্বাচনের দিন সকালে এরশাদুল আমিনের প্রত্যক্ষ মদদে ইসমাঈল সমর্থকরা কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। প্রচুর বহিরাগত সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে অস্ত্র-সন্ত্র সমেত দখল করে নেয়া হয় ৬ টি নির্বাচনী কেন্দ্র। কেন্দ্র থেকে ইসমাঈল বাহিনীর লোকজন অন্য সকল প্রার্থীর লোকজনকে বের করে করে দেয়।
নগরীর আরেক সহিংস প্রবন ৯ নং ওয়ার্ড থেকে বিজয়ী আ জ ম নাছিরের একান্ত অনুসারী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ জহুরুল আলম জসিম । এবারের চসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর জসিম বেশ আলোচিত ছিলেন। দুধর্ষ ক্যাডার ও ভূমি দস্যু হিসেবে পরিচিত জসিম আ জ ম নাছির ও এরশাদুল আমিনের ছত্রছায়ায় অবৈধ উপায়ে উপার্জন করে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এবারের নির্বাচনে এরশাদুল আমিনের প্রত্যক্ষ সমর্থনে একতরফা কেন্দ্র দখল করে কাউন্সিলর হিসেবে বিজয়ী হন। কাউন্সিলর সবুজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে বলতে শোনা যায় যে, আ জ ম নাছির তার ওয়ার্ডে নির্বাচনের দিন এসে তাকে সমর্থন দেবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরাজিত প্রার্থী বলেন, “এবারের চসিক নির্বাচনে আ জ ম নাছির ও এরশাদুল আমিনের ভরষায় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাম। কিন্ত অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া নেতারা একতরফা ভাবে মোহাম্মদ জহুরুল আলম জসিমের পক্ষে কাজ করেন।” তিনি আরও জানান, এ আসনে দুই নেতার সাথে সবুজের কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে।”
প্রশাসন কেন নিশ্চুপ ছিলেন?
সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের প্রকাশ্যে এমন সশস্ত্র কার্যকলাপে প্রশাসনকে দমিয়ে রাখার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন চট্টগ্রাম ১০ আসনের বর্তমান সাংসদ ডাঃ আফসারুল আমিনের অনুজ এরশাদুল আমিন। ডাঃ আফসারুল আমিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সংসদীয় কমিটির প্রেসিডেন্ট হওয়ায় এর পুরো সুযোগটি নেন এরশাদুল আমিন। এরশাদুল আমিনের চাপে প্রশাসন ছিলো বেকায়দায়। বিভিন্ন কেন্দ্রে এরশাদুল আমিনের ক্যাডার বাহিনী ও কিশোর গ্যাং প্রকাশ্যে কেন্দ্র দখল করে বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করলেও প্রশাসন ছিলো নির্বিকার। নগরীর ৯ নং ওয়ার্ড ও ১১ নং ওয়ার্ডে এরশাদুল আমিন প্রশাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করে নিজের বাহিনীকে একতরফা ভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেন।
এদিকে বুধবার (২৭ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম মেশিনে ভোটগণনা শেষে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়ার জন্য দুই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারকে চাপ প্রয়োগ করেন সংরক্ষিত ৪ আসনের প্রার্থী আবিদা আজাদ ও তার সমর্থকরা। জানা যায়, এরশাদুল আমিন এ প্রার্থীর পক্ষে ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করার জন্য প্রিজাইডিং অফিসারকে ফোনে চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু এতে সফল না হয়ে আবিদা আজাদ উল্টো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের দোষরোপ করেন এবং তাদের দায়িত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে আ জ ম নাছিরের একান্ত অনুসারী ও এরশাদুল আমিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সংরক্ষিত মহিলা আসন ১০ এর ১১,২৫,২৬ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রাধা রানী দেবী (টুনটু মুন) নির্বাচনের ফলাফলকে নিজের আয়ত্বে আনার জন্য কয়েক দফা চসিক নির্বাচনের একজন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু উক্ত আসনে দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে সাধারন ভোটারদের একতরফা সমর্থন থাকার কারনে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়াার সুযোগ ছিলো না।
বিষয়টি নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা হাসানুজ্জামানের মোবাইলে কয়েকদফা ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।