বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে আর কোনো জায়গা খালি নেই। গত দুই সপ্তাহে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর প্রায় ১০ হাজার বিরোধী দলের নেতা, সমর্থক ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই হাজার হাজার অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দি কয়েক মাস ধরে কারাগারের সেলের ভেতরে রয়েছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে ডজন ডজন, কারো বিরুদ্ধে শত শত ফৌজদারি অভিযোগ রয়েছে।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা প্রায় চার হাজার। সেখানে বন্দির সংখ্যা এখন ১৩ হাজার ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগ দল টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য ‘প্রধান বিরোধী দল’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ওপর নির্মম দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের খুব কম লোকই বিশ্বাস করে যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু বা গণতান্ত্রিক হবে। বিএনপি বলেছে, যতদিন হাসিনা দায়িত্বে থাকবেন, ততদিন তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক মাস ধরে বিরোধীদের হয়রানি চললেও, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির একটি সমাবেশ সরকারি দমন-পীড়নকে আরও জোরদার করতে প্ররোচিত করে। সমাবেশের আগের দিনগুলোতে বিএনপির শতাধিক নেতাকে আটক করা হয়। সেদিন, কয়েক হাজার বিএনপি সমর্থক রাস্তায় নামলে, হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুলিশের সঙ্গে, লাঠি, লোহার রড, ছুরি এবং অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সমাবেশে হামলা করতে দেখা যায়।
গার্ডিয়ান বলছে, সহিংসতায় একজন বিএনপি কর্মী, একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও একজন সাংবাদিকসহ অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেছেন, বিএনপিকে দমন করার জন্য কর্তৃপক্ষের দ্বারা সহিংসতা ‘পূর্বপরিকল্পিত’। সমাবেশের আগে এই সহিংসতার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ইন্টারনেট পরিষেবাগুলোকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল শুধুমাত্র কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যাহত করার জন্যই নয় বরং পুলিশের কর্মকাণ্ডের সরাসরি সম্প্রচার রোধ করার জন্যও।
পরবর্তীতে বিএনপি নেতারা এবং র্যাংক-এন্ড-ফাইল সদস্যরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে বাধা দেওয়ার জন্য তাদের নিশানা করা হয়েছে। রবার্ট এফ কেনেডি মানবাধিকার সংস্থার ভাইস-প্রেসিডেন্ট অ্যাঞ্জেলিটা বেয়েন্স বলছেন, গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশে বিরোধী নেতা, কর্মী এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতারের সংখ্যা প্রমাণ করে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন কতটা চরম আকার ধারণ করেছে।
গ্রেফতার হওয়া কয়েক হাজার সদস্যের মধ্যে বিএনপির অন্যতম সিনিয়র নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রয়েছেন। ২৯ অক্টোবর আটক করার কয়েক ঘণ্টা আগে গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। মির্জা আলমগীর বলেছিলেন, আমরা অগণিত ঘটনা দেখেছি যেখানে আমাদের কর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশ এবং বিচার বিভাগ আমাদের নীরব করার জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।
গ্রেফতার এড়িয়ে যাওয়া কয়েকজন বিএনপি নেতা এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে এখন ৪৫০টিরও বেশি মামলা রয়েছে এবং ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভের পর সহিংসতা ও হত্যার অভিযোগে ১৭০ জন নেতাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে সোহেল আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন। একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে সোহেল বর্ণনা করেছেন যে, কীভাবে গত কয়েক মাস ধরে তার বিরুদ্ধে অন্তহীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের দৌড়ে তিনি একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন – শেখ হাসিনাকে পুনরায় নির্বাচিত করার জন্য নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছিল – সোহেলকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বাধা দেওয়া হয়েছিল।
হাবিব উন নবী খান সোহেল আরও বলেন, জুন মাস থেকে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাতটি মামলার শুনানির জন্য আমাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। আমার অনেক সিনিয়র সহকর্মী শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন এবং প্রতিদিন আদালতে দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছেন।
আরেক মধ্য-স্তরের বিএনপি নেতা আজিজুর রহমান মুছাব্বির (৪১) গ্রেফতার ও মুক্তির পাকেচক্রে আটকে আছেন। একটি সমাবেশে সহিংসতা শুরু হওয়ার পরে ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর তাকে প্রথম গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং ফেব্রুয়ারিতে তাকে জামিন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কারাগারের দরজার বাইরে পুলিশ তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে। তিনি মার্চ মাসে আবার জামিনে মুক্তি পান এবং আবার অবিলম্বে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। এ চক্র সমানে চলছে। তিনি এখন আবার কারাগারে ফিরে এসেছেন ৭০টি বিভিন্ন অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে। আজিজুর রহমানের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম আক্ষেপের সুরে বলেন, সরকার তাকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখার জন্য কারাগারে আটক রেখেছে, আমরা সবাই হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার। যেহেতু শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে প্রথম নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাকে বাংলাদেশে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার চারটি পদের মেয়াদ গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ এবং ভিন্নমত বা যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক বিরোধীতার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ দ্বারাও সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
বিএনপির কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে বিএনপি ও এর সদস্য সংগঠনের ৫০ লাখের বেশি নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বিরুদ্ধে ১৩৮ হাজারেরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্টের মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের নথিপত্র করছেন, তিনি বলেছেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বলপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন। বাংলাদেশে যখনই নির্বাচন হয় তখনই বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ভুয়া ফৌজদারি মামলা ঠুকে বিরোধী কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং তাদের নির্বিচারে আটক করা হয়। ২০১৮ সালের আগের নির্বাচনে বিরোধীদের হয়রানি এবং ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ ওঠে। সেই নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে নিন্দা করা হয়েছিল। বেশিরভাগই এখন অনুমান করেন যে, অনুরূপ দৃশ্য জানুয়ারিতেও দেখা যাবে ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সংঘটিত করার জন্য হাসিনাকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সপ্তাহে বৃটিশ হাইকমিশনার সহিংসতা পরিহার এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার আহ্বান জানাতে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। মার্কিন সরকার সম্প্রতি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল করার জন্য অজ্ঞাতনামা সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং গত মাসে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হাসিনাকে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভণ্ডামির অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাল্টা আঘাত করেছেন। তিনি বলেন – বাইডেন কি কখনো ট্রাম্পের সঙ্গে সংলাপ করেছেন? যেদিন তাদের সংলাপ হবে, আমিও বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকার এখন বিচার বিভাগ ও পুলিশকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের অস্ত্র তৈরি করেছে। এই সপ্তাহে, একটি ভিডিও ক্লিপে টহলরত পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে একদল সশস্ত্র আওয়ামী কর্মীদের বলতে শোনা গেছে, এক একটি করে বিএনপি লোকদের ধরুন এবং তাদের সবাইকে হত্যা করুন।
যদিও বিএনপি সদস্যদের গণগ্রেফতারের বিষয়টি আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত বলে সরকার ও পুলিশ উভয়েই অস্বীকার করছে। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই ফৌজদারি মামলাগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা গার্ডিয়ানের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেননি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ২৮ অক্টোবরের সমাবেশে পুলিশ কর্মকর্তাদের হত্যা ও আহত করার জন্য দায়ীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোবাশ্বের হাসান বলেছেন যে, শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক পদ্ধতিগুলো বিএনপির আন্দোলনের গতি বাড়াচ্ছে, কারণ হাসিনার সরকার এখন দুর্বল অর্থনীতি এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের বিক্ষোভের সম্মুখীন হচ্ছে। কারণ ২৮ অক্টোবরের সমাবেশে রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি দরিদ্র শ্রমিকরাও দলে দলে অংশ নেন। হাসান বলেন, সাধারণ মানুষের স্পন্দনের সঙ্গে মিশে গেছে বিএনপির সমাবেশগুলো। বিএনপির ক্রমবর্ধমান গতিকে বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে পূর্ণ প্রস্ফুটিত গণআন্দোলনে বিকশিত হওয়া থেকে বিরত করার লক্ষ্যে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপকে একটি ‘পরিকল্পিত পদক্ষেপ’ বলেই মনে হচ্ছে।