০২:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলা‌দে‌শের অর্থ‌নৈ‌তিক বিকাশ বি‌শ্বের কা‌ছে শিক্ষনীয়।

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৪:৪৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুন ২০২১
  • 99

ভারতের সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করে জন্ম নেওয়া স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ মাত্র ৫০ বছরেই গোটা দুনিয়াকে দেখাচ্ছে আর্থিক বিকাশের পথ। অন্যদিকে, ভুল নীতির কারণে চরম অর্থ সংকটে সরকারি কর্মীদের বেতন দিতেই হিমশিম খাচ্ছে পাকিস্তান। আর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বাংলাদেশ আজ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আর্থিক বুনিয়াদের ওপর দাঁড়াতে চলেছে। পশ্চিমা দুনিয়াও বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সাফল্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন পোর্টাল ‘সাবস্টাক’-এ বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমালোচক নোহ স্মিথ ‘নোহপিনিয়িন’ কলামে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির ভূয়সী প্রশংসা। উঠে এসেছে গোটা দুনিয়াকে কীভাবে বাংলাদেশ নতুন অর্থনৈতিক দিশা দেখাচ্ছে সে কথাও। নোহ মনে করেন, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে রপ্তানিমূলক উৎপাদনের হার বাড়িয়ে বাংলাদেশ গোটা দুনিয়াকে উন্নয়নের নতুন পথ দেখাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকা বা পূর্ব এশিয়ায় বাইরেও যে রপ্তানি বাণিজ্যের হাত ধরে উন্নয়ন সম্ভব, সেটিও প্রমাণ করে চলেছে বাংলাদেশ।

জাপান, তাইওয়ান বা চীন উন্নতি করলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে চিরকাল হতাশাই ব্যক্ত করে এসেছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ নিয়ে তো জন্মলগ্ন থেকেই নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে এসেছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জো স্টিগ্লিটজ এবং ড্যানি রড্রিক তো বলে আসছিলেন, পূর্ব এশিয়া বা ইউরোপের বাইরে রপ্তানিকেন্দ্রিক উৎপাদনের মাধ্যমে উন্নয়ন সম্ভবই নয়। ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার বাইরের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে স্টিগিল্গটজ চিরকাল রপ্তানিকেন্দ্রিক উৎপাদনশীল অর্থনীতির বদলে অন্য কোনো পথ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। তার আশঙ্কা ছিল, অচিরেই বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকরা কাজ হারাবেন। দুনিয়া জুড়ে চলবে শুধু যন্ত্রনির্ভর শিল্প। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো। মোদ্দা কথায়, ইউরোপ বা পূর্ব এশিয়ার বাইরে কলকারখানার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বহু অর্থনীতিবিদ ভাবতেই পারেননি।

মালয়েশিয়া, তুরস্ক বা ইসরায়েলকে তারা ব্যতিক্রম বলে মনে করেছেন। নোহ মনে করেন, দুনিয়ার অর্থনীতিবিদদের ভুল ভাঙাতে পারে একমাত্র বাংলাদেশের শিল্পায়ন। পূর্ব এশিয়া বা ইউরোপের বাইরেও সফল শিল্পায়ন সম্ভব, সেটা দেশটি সাফল্যের সঙ্গে করে দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক প্রশংসায় ভরে উঠেছে নোহের লেখা। ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন উল্লেখ করে তিনি জানান, মাথাপিছু গড় আয়ে পাকিস্তানকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গেও জিডিপির ফারাক কমছে। ভারতীয়দের ক্রয়ক্ষমতা এখনও বেশি হলেও নোহ মনে করেন, এক্ষেত্রেও দ্রুত এগিয়ে আসছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, উন্নয়নের নিরিখে আরও পিছিয়ে পড়ছে পাকিস্তান। দুর্নীতি আর জঙ্গিবাদীদের তোষণ করতে গিয়ে পাকিস্তান প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছে। কর্মচারীদের বেতন দিতেও তাদের অন্য দেশের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। ফরেন রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে। চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বেইজিং থেকে ঋণ নিয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্বকেও চীনের কাছে বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে ইমরান খানের সরকার। এমনটা বলছেন সে দেশেরই অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ। তাদের মতে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুখে যা-ই বলুন না কেন, দেশকে ভুল পথে চালিত করে অর্থনীতির সর্বনাশা পথে পূর্বসূরিদেরই তিনি সহযাত্রী। অন্যদিকে, সঠিক পথ বেছে নেওয়ায় বাংলাদেশের আর্থিক উন্নতি আজ গোটা দুনিয়াতেই প্রশংসিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাফল্যের মধ্যেও মৌলবাদীদের উত্থানের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা জরুরি বাংলাদেশের। কারণ পাকিস্তানপন্থি স্বার্থান্বেষী মহল এই উন্নয়নের বহর সহ্য করতে পারছে না। অতীতের মতোই ফের তারা সক্রিয় হওয়ার মতলব কষছে। সেটা নিয়েই চিন্তিত আন্তর্জাতিক মহল। বিষয়টি নজর এড়ায়নি নোহের। পাশাপাশি তিনি অবশ্য তার নোহপিনিয়িন-এ বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৭ শতাংশে উত্তরণের প্রশংসা করতে ভোলেননি। তার মতে, দারিদ্র্য বৃদ্ধির হারেই শুধু টেক্কা দিচ্ছে পাকিস্তান। আর অর্থনীতির সব সূচকেই এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই আকাশচুম্বী উন্নয়নের কারণ অনুসন্ধানেরও আলোকপাতের চেষ্টা করেছেন এই পশ্চিমা লেখক। তার মতে, ২০০ বছর আগে ব্রিটেন যেভাবে তৈরি ও বিক্রির নীতিকে আগলে ধরে শিল্পায়নে মনোযোগী হয়ে সফল হয়েছিল, ঠিক সেই নীতিরই সফল রূপায়ণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এদেশের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের সুনাম এখন দুনিয়া জুড়ে। নামিদামি কোম্পানির পোশাকে লেগে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। পোশাক রপ্তানিতে চীন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও এগিয়ে। কিন্তু ভিয়েতনামকে হটিয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছে তিন নম্বরে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে পোশাক এক নম্বর পণ্য। একনজরে দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্যের তালিকা- ১. বুনন বা কারুশিল্পে তৈরি পোশাক ও আনুষাঙ্গিক :২০.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (রপ্তানির ৪৪.৫ %); ২. পোশাক ও আনুষাঙ্গিক (বুনন ছাড়া) :১৯.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪২.৪%); ৩. জুতা :১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২.৪%); ৪. টেপটাইলস সামগ্রী ও জীর্ণ পোশাক :১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২.২%); ৫. কাগজের তন্তু ও বোনা ফেব্রিক :৬০৩.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১.৩ %); ৬. মাছ :৫৩২.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১.২ %); ৭. চামড়া ও পশুর দেহাংশ :৩৬৮.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (০.৮%); ৮. পাগড়ি : ৩৩২.৬ মিলিয়ান মার্কিন ডলার (০.৭ %); ৯. কাঁচা চামড়া ও অন্যান্য সামগ্রী :১৩৯.৮ মিলিয়ন ডলার (০.৩ %); ১০. পল্গাস্টিক সামগ্রী :১১৩.২ মিলিয়ন ডলার (০.২ %)।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কোথায় বিক্রি হয় সেটিও তুলে ধরেন নোহ। দেখা যায় বেশিরভাগ পোশাকই যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপেল্গপিটি বা অর্থনৈতিক জটিলতার পর্যবেক্ষণের তৈরি নিচের এই চার্টটি তিনি তুলে ধরেন তার প্রতিবেদনে।

বিশ্ববন্দিত সংস্থা ম্যাককিন্সির বুঝতে অসুবিধা হয়নি, গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনার বিষয়টি। তবে রাতারাতি বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন কোনো জাদুদণ্ডের সাহায্যে হয়নি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তাদের ২০৮ পাতার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিল্পনীতির ব্যাখ্যা করেছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সত্তরের দশকের শুরুতেই বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা পাঁচ বছরের সুপরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন শিল্পভাবনাকে বিকশিত হতে সাহায্য করেছে। গার্মেন্ট শিল্পকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি সুগম করা হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগের পথকেও। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরিও প্রশংসিত হয়েছে নোহের মূল্যায়নে। সেইসঙ্গে তিনি উলেল্গখ করেছেন রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ আন্তরিকতারও। কর ও শুল্ক্ক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকার রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়ে উৎসাহিত করেছে বিনিয়োগকারীদের। ব্রিটেনের শিল্পবিপল্গবের মতোই উৎপাদনশীল কল-কারখানা স্থাপনে পরিকল্পনামাফিকই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ রড্রিকের মূল্যায়নকে ভুল প্রমাণ করেই মিলেছে সাফল্য। পাকিস্তান গরিব থেকে গরিবতর হলেও বাংলাদেশ কিন্তু উৎপাদনমুখী অর্থনীতির হাত ধরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। মানব সম্পদ-নির্ভর শিল্পায়নের ঝুঁকিগত দিক দেখিয়ে অনেকেই বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপক যন্ত্রনির্ভর শিল্পায়নের সময়ও মানবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সফল শিল্পায়নের উদাহরণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। তবে মৌলবাদীরা বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে। তাই এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

নোহ মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান সাফল্যকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নেই। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, ধনী দেশের তকমা পেতে বাংলাদেশকে আরও অনেকটা দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও রপ্তানি নির্ভর উৎপাদনশীল অর্থনীতি এবং পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপে নিজেদের বাজার বৃদ্ধি তাদের সেই উন্নয়নের পথকে সুগম করবে। পাকিস্তানসহ বহু দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এশিয়ান বাঘের গর্জনে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে বলেও তিনি মনে করেন। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অবহেলা করার আজ আর কোনো অবকাশ নেই। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির পথে আশার আলো দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের নিরিখে পশ্চিমা দুনিয়াও আজ আমাদের সমীহ করছে। এখনকার মতো সঠিক পথে পরিচালিত হলে আগামী দিনে দুনিয়াকে শুধু আর্থিক উন্নয়নের দিশাই দেখাবে না, ধনী দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে, বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত।

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

ভারতে ৩শ’ রুপির গয়না ৬ কোটিতে বিক্রি করে মার্কিন নারীর সঙ্গে প্রতারণা।

বাংলা‌দে‌শের অর্থ‌নৈ‌তিক বিকাশ বি‌শ্বের কা‌ছে শিক্ষনীয়।

Update Time : ০৪:৪৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ জুন ২০২১

ভারতের সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করে জন্ম নেওয়া স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ মাত্র ৫০ বছরেই গোটা দুনিয়াকে দেখাচ্ছে আর্থিক বিকাশের পথ। অন্যদিকে, ভুল নীতির কারণে চরম অর্থ সংকটে সরকারি কর্মীদের বেতন দিতেই হিমশিম খাচ্ছে পাকিস্তান। আর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বাংলাদেশ আজ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আর্থিক বুনিয়াদের ওপর দাঁড়াতে চলেছে। পশ্চিমা দুনিয়াও বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সাফল্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন পোর্টাল ‘সাবস্টাক’-এ বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমালোচক নোহ স্মিথ ‘নোহপিনিয়িন’ কলামে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির ভূয়সী প্রশংসা। উঠে এসেছে গোটা দুনিয়াকে কীভাবে বাংলাদেশ নতুন অর্থনৈতিক দিশা দেখাচ্ছে সে কথাও। নোহ মনে করেন, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে রপ্তানিমূলক উৎপাদনের হার বাড়িয়ে বাংলাদেশ গোটা দুনিয়াকে উন্নয়নের নতুন পথ দেখাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকা বা পূর্ব এশিয়ায় বাইরেও যে রপ্তানি বাণিজ্যের হাত ধরে উন্নয়ন সম্ভব, সেটিও প্রমাণ করে চলেছে বাংলাদেশ।

জাপান, তাইওয়ান বা চীন উন্নতি করলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে চিরকাল হতাশাই ব্যক্ত করে এসেছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ নিয়ে তো জন্মলগ্ন থেকেই নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে এসেছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জো স্টিগ্লিটজ এবং ড্যানি রড্রিক তো বলে আসছিলেন, পূর্ব এশিয়া বা ইউরোপের বাইরে রপ্তানিকেন্দ্রিক উৎপাদনের মাধ্যমে উন্নয়ন সম্ভবই নয়। ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার বাইরের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে স্টিগিল্গটজ চিরকাল রপ্তানিকেন্দ্রিক উৎপাদনশীল অর্থনীতির বদলে অন্য কোনো পথ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। তার আশঙ্কা ছিল, অচিরেই বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকরা কাজ হারাবেন। দুনিয়া জুড়ে চলবে শুধু যন্ত্রনির্ভর শিল্প। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো। মোদ্দা কথায়, ইউরোপ বা পূর্ব এশিয়ার বাইরে কলকারখানার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বহু অর্থনীতিবিদ ভাবতেই পারেননি।

মালয়েশিয়া, তুরস্ক বা ইসরায়েলকে তারা ব্যতিক্রম বলে মনে করেছেন। নোহ মনে করেন, দুনিয়ার অর্থনীতিবিদদের ভুল ভাঙাতে পারে একমাত্র বাংলাদেশের শিল্পায়ন। পূর্ব এশিয়া বা ইউরোপের বাইরেও সফল শিল্পায়ন সম্ভব, সেটা দেশটি সাফল্যের সঙ্গে করে দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক প্রশংসায় ভরে উঠেছে নোহের লেখা। ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন উল্লেখ করে তিনি জানান, মাথাপিছু গড় আয়ে পাকিস্তানকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গেও জিডিপির ফারাক কমছে। ভারতীয়দের ক্রয়ক্ষমতা এখনও বেশি হলেও নোহ মনে করেন, এক্ষেত্রেও দ্রুত এগিয়ে আসছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, উন্নয়নের নিরিখে আরও পিছিয়ে পড়ছে পাকিস্তান। দুর্নীতি আর জঙ্গিবাদীদের তোষণ করতে গিয়ে পাকিস্তান প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছে। কর্মচারীদের বেতন দিতেও তাদের অন্য দেশের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। ফরেন রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে। চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে বেইজিং থেকে ঋণ নিয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্বকেও চীনের কাছে বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছে ইমরান খানের সরকার। এমনটা বলছেন সে দেশেরই অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ। তাদের মতে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুখে যা-ই বলুন না কেন, দেশকে ভুল পথে চালিত করে অর্থনীতির সর্বনাশা পথে পূর্বসূরিদেরই তিনি সহযাত্রী। অন্যদিকে, সঠিক পথ বেছে নেওয়ায় বাংলাদেশের আর্থিক উন্নতি আজ গোটা দুনিয়াতেই প্রশংসিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাফল্যের মধ্যেও মৌলবাদীদের উত্থানের বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা জরুরি বাংলাদেশের। কারণ পাকিস্তানপন্থি স্বার্থান্বেষী মহল এই উন্নয়নের বহর সহ্য করতে পারছে না। অতীতের মতোই ফের তারা সক্রিয় হওয়ার মতলব কষছে। সেটা নিয়েই চিন্তিত আন্তর্জাতিক মহল। বিষয়টি নজর এড়ায়নি নোহের। পাশাপাশি তিনি অবশ্য তার নোহপিনিয়িন-এ বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫ থেকে ৭ শতাংশে উত্তরণের প্রশংসা করতে ভোলেননি। তার মতে, দারিদ্র্য বৃদ্ধির হারেই শুধু টেক্কা দিচ্ছে পাকিস্তান। আর অর্থনীতির সব সূচকেই এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এই আকাশচুম্বী উন্নয়নের কারণ অনুসন্ধানেরও আলোকপাতের চেষ্টা করেছেন এই পশ্চিমা লেখক। তার মতে, ২০০ বছর আগে ব্রিটেন যেভাবে তৈরি ও বিক্রির নীতিকে আগলে ধরে শিল্পায়নে মনোযোগী হয়ে সফল হয়েছিল, ঠিক সেই নীতিরই সফল রূপায়ণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এদেশের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজের সুনাম এখন দুনিয়া জুড়ে। নামিদামি কোম্পানির পোশাকে লেগে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। পোশাক রপ্তানিতে চীন বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও এগিয়ে। কিন্তু ভিয়েতনামকে হটিয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছে তিন নম্বরে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে পোশাক এক নম্বর পণ্য। একনজরে দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্যের তালিকা- ১. বুনন বা কারুশিল্পে তৈরি পোশাক ও আনুষাঙ্গিক :২০.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (রপ্তানির ৪৪.৫ %); ২. পোশাক ও আনুষাঙ্গিক (বুনন ছাড়া) :১৯.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪২.৪%); ৩. জুতা :১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২.৪%); ৪. টেপটাইলস সামগ্রী ও জীর্ণ পোশাক :১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২.২%); ৫. কাগজের তন্তু ও বোনা ফেব্রিক :৬০৩.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১.৩ %); ৬. মাছ :৫৩২.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১.২ %); ৭. চামড়া ও পশুর দেহাংশ :৩৬৮.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (০.৮%); ৮. পাগড়ি : ৩৩২.৬ মিলিয়ান মার্কিন ডলার (০.৭ %); ৯. কাঁচা চামড়া ও অন্যান্য সামগ্রী :১৩৯.৮ মিলিয়ন ডলার (০.৩ %); ১০. পল্গাস্টিক সামগ্রী :১১৩.২ মিলিয়ন ডলার (০.২ %)।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কোথায় বিক্রি হয় সেটিও তুলে ধরেন নোহ। দেখা যায় বেশিরভাগ পোশাকই যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপেল্গপিটি বা অর্থনৈতিক জটিলতার পর্যবেক্ষণের তৈরি নিচের এই চার্টটি তিনি তুলে ধরেন তার প্রতিবেদনে।

বিশ্ববন্দিত সংস্থা ম্যাককিন্সির বুঝতে অসুবিধা হয়নি, গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনার বিষয়টি। তবে রাতারাতি বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন কোনো জাদুদণ্ডের সাহায্যে হয়নি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তাদের ২০৮ পাতার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিল্পনীতির ব্যাখ্যা করেছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সত্তরের দশকের শুরুতেই বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা পাঁচ বছরের সুপরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন শিল্পভাবনাকে বিকশিত হতে সাহায্য করেছে। গার্মেন্ট শিল্পকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি সুগম করা হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগের পথকেও। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরিও প্রশংসিত হয়েছে নোহের মূল্যায়নে। সেইসঙ্গে তিনি উলেল্গখ করেছেন রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ আন্তরিকতারও। কর ও শুল্ক্ক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকার রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিয়ে উৎসাহিত করেছে বিনিয়োগকারীদের। ব্রিটেনের শিল্পবিপল্গবের মতোই উৎপাদনশীল কল-কারখানা স্থাপনে পরিকল্পনামাফিকই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ রড্রিকের মূল্যায়নকে ভুল প্রমাণ করেই মিলেছে সাফল্য। পাকিস্তান গরিব থেকে গরিবতর হলেও বাংলাদেশ কিন্তু উৎপাদনমুখী অর্থনীতির হাত ধরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। মানব সম্পদ-নির্ভর শিল্পায়নের ঝুঁকিগত দিক দেখিয়ে অনেকেই বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপক যন্ত্রনির্ভর শিল্পায়নের সময়ও মানবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সফল শিল্পায়নের উদাহরণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। তবে মৌলবাদীরা বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে। তাই এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

নোহ মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান সাফল্যকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নেই। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, ধনী দেশের তকমা পেতে বাংলাদেশকে আরও অনেকটা দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও রপ্তানি নির্ভর উৎপাদনশীল অর্থনীতি এবং পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপে নিজেদের বাজার বৃদ্ধি তাদের সেই উন্নয়নের পথকে সুগম করবে। পাকিস্তানসহ বহু দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এশিয়ান বাঘের গর্জনে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে বলেও তিনি মনে করেন। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অবহেলা করার আজ আর কোনো অবকাশ নেই। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির পথে আশার আলো দেখিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের নিরিখে পশ্চিমা দুনিয়াও আজ আমাদের সমীহ করছে। এখনকার মতো সঠিক পথে পরিচালিত হলে আগামী দিনে দুনিয়াকে শুধু আর্থিক উন্নয়নের দিশাই দেখাবে না, ধনী দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে, বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত।