২০২৪ সালের জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন কাছাকাছি আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ২৮শে অক্টোবরের সমাবেশের পর প্রায় ১০ হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারগুলোতে কোনো কক্ষ অবশিষ্ট নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছিল বিরোধী দল বিএনপি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের জন্য ক্ষমতায় আসতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের পরিকল্পনামাফিক গ্রেপ্তার করছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের রাজনীতির কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, আওয়ামী লীগ চলতি বছরের জুলাইয়ে হুন সেনের অধীনে কম্বোডিয়ার নির্বাচনের টেমপ্লেট অনুসরণ করছে। নির্বাচনের আগে হুন সেন একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী দল ক্যান্ডেললাইট পার্টির প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। নির্বাচনের কাছাকাছি এসে তিনি ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করেন। ২৩শে জুলাই, হুন সেনের কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি) নির্বাচনে বিশাল ভোট পেয়ে নিজেদের বিজয়ী বলে ঘোষণা করে। সেই নির্বাচনে ১৭টি ছোট দল অংশ নিয়েছিল যাদের কোনো জনপ্রিয় সমর্থন ছিল না। জুলাইয়ের ভোটের আগেও, হুন সেন গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন যে, নির্বাচনে জয়লাভ করার পর, তিনি তার পুত্র হুন মানেতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, যা তিনি ২২শে আগস্ট করেছেন।
যাই হোক, তিনি এখন সিংহাসনের পেছনের শক্তি, দলের প্রধান, সিনেটের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য এবং প্রিভি কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত। কারচুপির নির্বাচনের পর কম্বোডিয়ায় যেসব ব্যক্তি গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করার দায়ে অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিছু বিদেশি সহায়তা কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একই ধরনের হুমকি দিয়েছে, কিন্তু নির্বাচনের আগে। তবুও শেখ হাসিনা তার একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দিতে রাজি নয়। তিনি বিএনপিকে বিভক্ত করে নেতৃত্বকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২৮শে অক্টোবরের সমাবেশের পর থেকে বিএনপি’র ১২ শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকিরা আত্মগোপন করেছেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গৃহবন্দি। তিনি একাধিক রোগে আক্রান্ত, তাই তাকে যদিও বা মুক্তি দেয়া হয় তিনি ভোট প্রচারণায় শামিল হতে পারবেন না। তার ছেলে এবং বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে থাকায় আওয়ামী লীগ সম্ভবত আশা করছে যে, বিএনপি’র পদমর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। দলকে বিভক্ত করার জন্য এখন পর্যন্ত বিএনপি থেকে কোনো নেতাকে টানতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন (ইসি) তিনটি অপেক্ষাকৃত নতুন দলকে স্বীকৃতি দিয়েছে: ফেব্রুয়ারিতে তৃণমূল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (টিবিএনপি) এবং জুলাইয়ে বাংলাদেশ জাতীয় আন্দোলন (বিএনএম) দল ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)কে (একটি ইসলামিক সংগঠন) স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতারা দাবি করেন যে, বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও বা বাধা দিলেও দলকে বিভক্ত করার জন্য মাঠ প্রস্তুত করা এবং এই দলগুলোকে নিয়ে ‘বহুদলীয়’ নির্বাচন দেখানোর পরিকল্পনা চলছে। এরপরও কী বিজয়ী শেখ হাসিনা কম্বোডিয়ার টেমপ্লেট অনুসরণ করবেন? কম্বোডিয়ার নির্বাচন সফলভাবে হাইজ্যাক করার পর হুন সেন দৃঢ়ভাবে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। আন্তর্জাতিক সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি চীনকে দিয়েছিলেন তাদের দ্বিতীয় বৈশ্বিক সামরিক ঘাঁটি (প্রথমটি জিবুতিতে) থাইল্যান্ড উপসাগরের রেমে। যেটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালীর কাছে অবস্থিত। অর্থনৈতিক নির্ভরতার জন্য নমপেন বেইজিংয়ের কাছে আবদ্ধ। এটি আসিয়ানে চীনের বিড়ালের থাবা হিসেবে কাজ করেছে- বেইজিংয়ের সমালোচনামূলক বিবৃতি থেকে শুরু করে দক্ষিণ চীন সাগরে আসিয়ান দেশগুলোর নৌ মহড়ার বিরোধিতা করা পর্যন্ত।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনার বিজয় কী চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়াবে? কক্সবাজারের পেকুয়ায় বিএনএস শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটি সম্প্রসারণের জন্য চীন শেষ পর্যন্ত তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প সংক্রান্ত (বর্তমানে আটকে থাকা) একটি চুক্তি পাবে বলে জল্পনা রয়েছে। ঢাকা এমনকি সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটি পুনরায় পরীক্ষা করতে পারে, যা পরিবেশগত কারণে বাতিল করা হয়েছিল। এটি সম্ভবত ভারত ও চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে উঠতে পারে। ভারত হয়তো শেখ হাসিনার পুনঃনির্বাচনে লাভবান হবে বলে আশা করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথভাবে তিনটি বড় অবকাঠামো প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন- আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, খুলনা-মোংলা বন্দর সংযোগ এবং রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্টের ইউনিট-২, যা বাংলাদেশে ভারতের অংশীদারিত্ব বাড়াচ্ছে এবং পরোক্ষভাবে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে।
যাই হোক, একটি ছোট অর্থনীতি হওয়ার কারণে ভারত হয়তো অপ্রতিরোধ্য হতে পারে, এবং চীন আরও সামগ্রিক ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা পেতে পারে। ইতিমধ্যে, একটি রাশিয়া-চীন অক্ষের উত্থান হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ তাদের ডি-ডলারাইজেশন প্রচেষ্টার অংশ হয়ে উঠেছে। খরচ-সাশ্রয়ী বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার-নির্ধারিত অর্থায়নের পরিবর্তে চীনের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ানে ঋণের অফার নিয়ে এগিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে। চীনের ক্রস-বর্ডার আন্তঃব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে রাশিয়া কর্তৃক নির্মিত পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য ঢাকা ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে চায়। এটি ইউয়ানকে উন্নীত করতে এবং ডলারের আধিপত্য ক্ষয় করার জন্য ২০১৫ সালে চালু করা হয়েছিল। এটি রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক, যা প্রতিদ্বন্দ্বী SWIFT পেমেন্ট সিস্টেম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন স্পষ্টতই ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে পূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে চীনের চ্যালেঞ্জ দেখছে, ভারত অদ্ভুতভাবে তার ভূ- কৌশলগত প্রতিপক্ষের মতো একই অবস্থানে রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর গণমাধ্যমকে বলেছেন- ‘আমার ৩৬ বছরের বেসরকারি ও সরকারি চাকরি জীবনে আমি কখনোই এই বিশাল অর্থনৈতিক সংকট প্রত্যক্ষ করিনি।’ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি (বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যে) বাড়ছে এবং প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো দেশ ছাড়ছে।
সাধারণ ঐকমত্য অনুযায়ী কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় ফেরা অনিশ্চিত। তবে তিনি ফিরে আসবেন- সম্ভবত তার ছেলের জন্য উত্তরাধিকার পরিকল্পনা নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং কন্যা দিল্লিতে অবস্থিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাই বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারত যেভাবে তাদের তাস খেলবে তার ফল সুদূরপ্রসারী পরিণতি ডেকে আনবে।
(বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড থেকে অনূদিত)