০৮:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ মার্চ ২০২৪, ৯ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নদীর নিচে ডুবে যাওয়া একটি চরের ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ আজ

  • Reporter Name
  • Update Time : ১২:৩৯:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ জুন ২০২২
  • 18

ইউনিয়নে ভোটারের বসবাস নেই তবুও ভোট

একটি চর নিয়ে গঠিত হাজীপুর ইউনিয়ন। ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলায় অবস্থিত ইউনিয়নটি। এ ইউনিয়নে একজন ভোটারও বসবাস করেন না। থাকেন না কোনো জনপ্রতিনিধি। তবে, ২১টি মহিষের টিলা আছে। রয়েছে কিছু মাছের আড়তও।

স্থানীয়দের দাবি, সে বেশ আগের কথা। বছর ত্রিশ-চল্লিশ হবে। তখন থেকে একটু একটু করে মেঘনার বুকে মিশে যেতে থাকে চরটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মূল চরটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তারপর থেকে সেখানে আর কোনো মানুষ বসবাস করতে পারেনি।

কিন্তু, শুধু মহিষ বসবাস করা এ ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামীকাল বুধবার এ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচন কর্মকর্তাদের দাবি, সরকারি নথিতে এ ইউনিয়নটির অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা। আজ সকালে শুরু হবে ভোটগ্রহণ।

সরকারি নথিতে থাকলেও যদিও বাস্তবে এ ইউনিয়নটির কোনো অস্তিত্ব দেখা মেলেনি। অথচ, সেখানেই কাল ভোট হবে। নির্বাচিত করা হবে প্রতিনিধিদের। যাঁরা নদীর নিচে ডুবে যাওয়া একটি চরের জনপ্রতিনিধি হবেন। যে চরে কোনো মানুষের বসবাস করার সুযোগ নেই। সেখানে এসব জনপ্রতিনিধিরা কার সেবা করবেন, এমন প্রশ্ন রেখেছেন স্থানীয় লোকজন।

যেহেতু অস্তিত্ব না থাকা একটি চরের ইউনিয়নের জন্য এ ভোটগ্রহণ করা হবে, সেহেতু সেখানে ভোটকেন্দ্র করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে, পৌরসভারধীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের (সরকারি নথি অনুযায়ী) ভোটগ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন স্থান থেকে এসে ভোটারদের ভোট দিতে হবে পৌরসভায় গিয়ে।

এ ইউনিয়নের ভোটগ্রহণ কেন করা হবে বা কার কী লাভ হবে, সেই প্রশ্ন তুলছেন ভোটাররা। এসব ব্যাপারে জানতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি মুঠোফোনে কথা বলেন না বলে জানিয়ে দেন।

তবে, নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার এবং প্রশাসন বলছে, কাগজপত্রে ইউনিয়ন আছে। ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন হচ্ছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালামের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, যে ইউনিয়নের অস্তিত্বই নেই; সেখানে ভোটগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল? উত্তরে তিনি বললেন, ‘ইসি তফসিল ঘোষণা করেছে, আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে আগাচ্ছি।’

ইউনিয়নের অস্তিত্ব আছে কি নেই, তফসিল ঘোষণার আগে ইসি আপনাদের কাছে জানতে চায়নি? এমন প্রশ্নে মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমার কাছে কোনোকিছু চাওয়া হয়নি। অইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা অন্য কারও কাছে চাওয়া হতে পারে।’

যা-ই হোক, আগামীকাল ভোটগ্রহণ হবে। ফলে, প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তে ছুটছে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বসবাসরত ভোটারদের কাছে। তবে, ভোটারদের অনেকে ভোট দিতে যাবেন না বলে জানিয়েছেন।

কথা প্রসঙ্গে এক ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি যে চেয়ারম্যান বা মেম্বার নির্বাচিত করব, তাঁদের কাজটা কী হবে? অনেকদিন তো হলো, সেখানে কোনো লোকজন বসবাস করে না। এ ছাড়া সরকার ইউনিয়নের জন্য যে আর্থিক বরাদ্দ দেয়, তাই-বা যায় কোথায়? আমি যে ভোট দেব, আমার লাভটা কী?’

দ্বীপ জেলা ভোলার চারপাশেই পানি। নদী ভাঙন কবলিত এই জেলাটি মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীবেষ্টিত। যে কারণে মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে দৌলতখান উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নটি। তবে, বাস্তবে না থাকলেও সরকারি কাগজপত্রে এখনও রয়ে গেছে ইউনিয়নটির অস্তিত্ব।

গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে করা হয়েছিল ভোটগ্রহণ। নির্বাচিত হয়েছিল চেয়ারম্যানসহ মেম্বাররা। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউনিয়নটিতে ৩ হাজার ৪৩৩ জন ভোটারের মধ্যে ১ হাজার ৭৪৬ জন পুরুষ আর ১৬৮৭ জন নারী রয়েছেন।

বাস্তবে ইউনিয়নের অস্তিস্ত না থাকায় দৌলতখান পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দৌলতখান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ওই ইউনিয়নের মোট ৯টি ওয়ার্ডের ভোটগ্রহণ করা হবে। ইভিএম’র মাধ্যমে এ ভোটগ্রহণ করা হবে। জেলা নির্বাচন অফিসার স্বাক্ষরিত চিঠিতে দেখা গেছে, এই বিদ্যালয় কেন্দ্রটিকেই স্থায়ী কেন্দ্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানে অস্থায়ী কেন্দ্র বলতে কিছু নেই।

হাজীপুরের এ ভোটকে কেন্দ্র করে দৌলতখান পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড পোস্টারে ছেয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী ভবানীপুর, চর খলিফা ও সৈয়দপুর ইউনিয়নেও পোস্টারে ছেয়ে গেছে। প্রার্থীরা এসব ইউনিয়নে পোস্টারিং করেছেন। প্রার্থীরা ছুটছেন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে।

চরখলিফা ইউনিয়নের মো. শরীফ নামের এক ভোটার বলেন, হাজীপুর ইউনিয়নটি মেঘনা নদীর মাঝখানে। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো বসতি নেই সেখানে। যে কারণে পৌরসভাসহ আশপাশের ইউনিয়নগুলোতে প্রার্থীরা পোস্টারিং করেছে।’

একই কথা বলেন সৈয়দপুর ইউনিয়নের মো. কেরামত আলী মিয়া। তিনি বলেন, ‘হাজীপুর ইউনিয়নে যারা বসবাস করতো তারা এখন দৌলতখান, ভোলা সদর, তজুমদ্দিন, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। এ ছাড়াও রাজধানী ঢাকা আর বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও বাসবাস করছে এ ইউনিয়নটির ভোটাররা।

এসব ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় আনারস প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. আবি আবদুল্যাহ পাটোয়ারী কিরণের কাছে। তবে, ইউনিয়নটি বিলীন হওয়ার কথা সরাসরি স্বীকার না করে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সুবিধার জন্য আবেদন করে পৌরসভার মধ্যে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছি।’

সে সময় মো. আবি আবদুল্যাহ অভিযোগ করে বলেন, ‘তাঁকে ও তাঁর সমর্থকদের নৌকার সমর্থকরা বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়ে আসছে।’

অপরদিকে নৌকা প্রতিকের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. হামিদুর রহমান বলেন, এখন আমি বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকিমউদ্দিন আছি। এর পর তজুমদ্দিন, লালমোহন হয়ে চরফ্যাশনের বেতুয়াতে যাব ভোটারদের কাছে। সকালে বের হই, আর রাতে ফিরি। ভোটাররা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় কষ্ট বেশি হচ্ছে।

সাবেক এই চেয়ারম্যান মো. হামিদুর রহমান আরও বলেন, আসলে ইউনিয়নের কিছুটা অংশ থাকলেও আছে।’ এরপর প্রশ্ন করা হয়, সেটা কি ডুবো চর? এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান তিনি।

দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তারেক হাওলাদার বলেন, ‘২০১১ সালের আদমশুমারি হিসেবে জনসংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন বিলুপ্ত বা নেই এর কোনো অফিসিয়াল অর্ডার নেই। বিবিএস পরিসংখ্যান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা। তারা ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা বিলুপ্ত বলতে পারি না। বিলুপ্ত হয়েছে এমন কোনো পত্র নেই। তাই বিলুপ্ত বলতে পারি না। ভোটের বিষয় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। জেলা, সদর ও দৌলতখান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা সরেজমিন দেখে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা পুরোপুরি তাদের বিষয়। আমরা প্রশাসন নিরাপত্তার বিষয়টি দেখব।’

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সৈয়দ শফিকুল হক বলেন, চরে যেহেতু বর্ষার সময় কোনো মানুষ থাকে না। সবাই মেইনল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বা এলাকায় থাকে। এছাড়া চরে ২১টি মহিষের টিলা ও মাছের আড়ত আছে। তাই সেখানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা নির্বাচনের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্তরা গিয়ে থাকতে পারবে না। তাই আমরা এসব দেখে কমিশনের কাছে মেইনল্যান্ডে নির্বাচন করার অনুমতি চেয়েছি এবং কমিশন অনুমতি দিয়েছে।

মহিষের ঘর আর মাছের আড়ত নিয়ে একটি ইউনিয়ন হয় কি না জানতে চাইলে সৈয়দ শফিকুল হক বলেন, ‘এটা দেওয়া আছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করেছে। তার প্রতিনিধি আমরা নির্বাচন করবো। তারা বন্ধ করে দিলে নির্বাচন করব না।’

জানা গেছে, হাজীপুর ইউনিয়নে দুজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। সংরক্ষিত মহিলা আসনে প্রার্থী ১০ জন। সাধারণ মেম্বারপদপ্রার্থী ২৩ জন। এর মধ্যে ৪ এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ডে একজন করে প্রার্থী থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

হাজীপুর ইউনিয়ন অন্তত ৩০ বছর আগে মেইনল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিছুটা অংশ ছিল ২০১৯ সালে। হেঁটে ছোট্ট খাল পার হয়ে যাওয়া যেত হাজীপুর ইউনিয়নে। এমনটাই জানালেন ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, সময়ের বিবর্তনে আজ তা ভয়াল মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। রয়েছে শুধু ছোট্ট একটু চর। সেটাও কখনো ডুবে থাকে, কখনো ভেসে ওঠে। তবে আমার সময় প্রায় ২ হাজার ৮০০ ভোটার ছিল। চরে দুটি গুচ্ছগ্রামসহ অন্তত প্রায় ৪শ পরিবারের বসবাস ছিল।

সাবেক ৩ নম্বর আর বর্তমান ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মো. শাহে আলম মাঝি। হাজীপুরের ভোটার হলেও ইউনিয়ন বিলীন হয়ে যাওয়ায় বসবাস করছেন সৈয়দপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নুর মিয়ারহাট বাজারের পাশে। ৬৫ বছরের এই জেলে বলেন, ‘ছোট বেলায় ফুটবল খেলতাম আর আজ সেই গ্রাম মেঘনার মাঝখানে। শুধু একটা মহিষ থাকার মাটির টিলা ছাড়া ইউনিয়ন বলতে কিছু নেই। সেখানে মানুষের কোনো বসবাসের চিহ্ন নেই। থাকে কিছু মহিষ।’

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

নদীর নিচে ডুবে যাওয়া একটি চরের ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ আজ

Update Time : ১২:৩৯:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ জুন ২০২২

একটি চর নিয়ে গঠিত হাজীপুর ইউনিয়ন। ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলায় অবস্থিত ইউনিয়নটি। এ ইউনিয়নে একজন ভোটারও বসবাস করেন না। থাকেন না কোনো জনপ্রতিনিধি। তবে, ২১টি মহিষের টিলা আছে। রয়েছে কিছু মাছের আড়তও।

স্থানীয়দের দাবি, সে বেশ আগের কথা। বছর ত্রিশ-চল্লিশ হবে। তখন থেকে একটু একটু করে মেঘনার বুকে মিশে যেতে থাকে চরটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মূল চরটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তারপর থেকে সেখানে আর কোনো মানুষ বসবাস করতে পারেনি।

কিন্তু, শুধু মহিষ বসবাস করা এ ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামীকাল বুধবার এ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচন কর্মকর্তাদের দাবি, সরকারি নথিতে এ ইউনিয়নটির অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণা করেছে। সে অনুযায়ী সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা। আজ সকালে শুরু হবে ভোটগ্রহণ।

সরকারি নথিতে থাকলেও যদিও বাস্তবে এ ইউনিয়নটির কোনো অস্তিত্ব দেখা মেলেনি। অথচ, সেখানেই কাল ভোট হবে। নির্বাচিত করা হবে প্রতিনিধিদের। যাঁরা নদীর নিচে ডুবে যাওয়া একটি চরের জনপ্রতিনিধি হবেন। যে চরে কোনো মানুষের বসবাস করার সুযোগ নেই। সেখানে এসব জনপ্রতিনিধিরা কার সেবা করবেন, এমন প্রশ্ন রেখেছেন স্থানীয় লোকজন।

যেহেতু অস্তিত্ব না থাকা একটি চরের ইউনিয়নের জন্য এ ভোটগ্রহণ করা হবে, সেহেতু সেখানে ভোটকেন্দ্র করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে, পৌরসভারধীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের (সরকারি নথি অনুযায়ী) ভোটগ্রহণ করা হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন স্থান থেকে এসে ভোটারদের ভোট দিতে হবে পৌরসভায় গিয়ে।

এ ইউনিয়নের ভোটগ্রহণ কেন করা হবে বা কার কী লাভ হবে, সেই প্রশ্ন তুলছেন ভোটাররা। এসব ব্যাপারে জানতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি মুঠোফোনে কথা বলেন না বলে জানিয়ে দেন।

তবে, নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার এবং প্রশাসন বলছে, কাগজপত্রে ইউনিয়ন আছে। ইসির ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন হচ্ছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালামের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, যে ইউনিয়নের অস্তিত্বই নেই; সেখানে ভোটগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল? উত্তরে তিনি বললেন, ‘ইসি তফসিল ঘোষণা করেছে, আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে আগাচ্ছি।’

ইউনিয়নের অস্তিত্ব আছে কি নেই, তফসিল ঘোষণার আগে ইসি আপনাদের কাছে জানতে চায়নি? এমন প্রশ্নে মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমার কাছে কোনোকিছু চাওয়া হয়নি। অইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা অন্য কারও কাছে চাওয়া হতে পারে।’

যা-ই হোক, আগামীকাল ভোটগ্রহণ হবে। ফলে, প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তে ছুটছে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বসবাসরত ভোটারদের কাছে। তবে, ভোটারদের অনেকে ভোট দিতে যাবেন না বলে জানিয়েছেন।

কথা প্রসঙ্গে এক ভোটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি যে চেয়ারম্যান বা মেম্বার নির্বাচিত করব, তাঁদের কাজটা কী হবে? অনেকদিন তো হলো, সেখানে কোনো লোকজন বসবাস করে না। এ ছাড়া সরকার ইউনিয়নের জন্য যে আর্থিক বরাদ্দ দেয়, তাই-বা যায় কোথায়? আমি যে ভোট দেব, আমার লাভটা কী?’

দ্বীপ জেলা ভোলার চারপাশেই পানি। নদী ভাঙন কবলিত এই জেলাটি মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীবেষ্টিত। যে কারণে মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে দৌলতখান উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নটি। তবে, বাস্তবে না থাকলেও সরকারি কাগজপত্রে এখনও রয়ে গেছে ইউনিয়নটির অস্তিত্ব।

গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে করা হয়েছিল ভোটগ্রহণ। নির্বাচিত হয়েছিল চেয়ারম্যানসহ মেম্বাররা। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউনিয়নটিতে ৩ হাজার ৪৩৩ জন ভোটারের মধ্যে ১ হাজার ৭৪৬ জন পুরুষ আর ১৬৮৭ জন নারী রয়েছেন।

বাস্তবে ইউনিয়নের অস্তিস্ত না থাকায় দৌলতখান পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দৌলতখান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ওই ইউনিয়নের মোট ৯টি ওয়ার্ডের ভোটগ্রহণ করা হবে। ইভিএম’র মাধ্যমে এ ভোটগ্রহণ করা হবে। জেলা নির্বাচন অফিসার স্বাক্ষরিত চিঠিতে দেখা গেছে, এই বিদ্যালয় কেন্দ্রটিকেই স্থায়ী কেন্দ্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানে অস্থায়ী কেন্দ্র বলতে কিছু নেই।

হাজীপুরের এ ভোটকে কেন্দ্র করে দৌলতখান পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড পোস্টারে ছেয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী ভবানীপুর, চর খলিফা ও সৈয়দপুর ইউনিয়নেও পোস্টারে ছেয়ে গেছে। প্রার্থীরা এসব ইউনিয়নে পোস্টারিং করেছেন। প্রার্থীরা ছুটছেন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে।

চরখলিফা ইউনিয়নের মো. শরীফ নামের এক ভোটার বলেন, হাজীপুর ইউনিয়নটি মেঘনা নদীর মাঝখানে। যার কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো বসতি নেই সেখানে। যে কারণে পৌরসভাসহ আশপাশের ইউনিয়নগুলোতে প্রার্থীরা পোস্টারিং করেছে।’

একই কথা বলেন সৈয়দপুর ইউনিয়নের মো. কেরামত আলী মিয়া। তিনি বলেন, ‘হাজীপুর ইউনিয়নে যারা বসবাস করতো তারা এখন দৌলতখান, ভোলা সদর, তজুমদ্দিন, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। এ ছাড়াও রাজধানী ঢাকা আর বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও বাসবাস করছে এ ইউনিয়নটির ভোটাররা।

এসব ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় আনারস প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. আবি আবদুল্যাহ পাটোয়ারী কিরণের কাছে। তবে, ইউনিয়নটি বিলীন হওয়ার কথা সরাসরি স্বীকার না করে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সুবিধার জন্য আবেদন করে পৌরসভার মধ্যে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করেছি।’

সে সময় মো. আবি আবদুল্যাহ অভিযোগ করে বলেন, ‘তাঁকে ও তাঁর সমর্থকদের নৌকার সমর্থকরা বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়ে আসছে।’

অপরদিকে নৌকা প্রতিকের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. হামিদুর রহমান বলেন, এখন আমি বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাকিমউদ্দিন আছি। এর পর তজুমদ্দিন, লালমোহন হয়ে চরফ্যাশনের বেতুয়াতে যাব ভোটারদের কাছে। সকালে বের হই, আর রাতে ফিরি। ভোটাররা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় কষ্ট বেশি হচ্ছে।

সাবেক এই চেয়ারম্যান মো. হামিদুর রহমান আরও বলেন, আসলে ইউনিয়নের কিছুটা অংশ থাকলেও আছে।’ এরপর প্রশ্ন করা হয়, সেটা কি ডুবো চর? এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান তিনি।

দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তারেক হাওলাদার বলেন, ‘২০১১ সালের আদমশুমারি হিসেবে জনসংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন বিলুপ্ত বা নেই এর কোনো অফিসিয়াল অর্ডার নেই। বিবিএস পরিসংখ্যান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থা। তারা ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা বিলুপ্ত বলতে পারি না। বিলুপ্ত হয়েছে এমন কোনো পত্র নেই। তাই বিলুপ্ত বলতে পারি না। ভোটের বিষয় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। জেলা, সদর ও দৌলতখান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা সরেজমিন দেখে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা পুরোপুরি তাদের বিষয়। আমরা প্রশাসন নিরাপত্তার বিষয়টি দেখব।’

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সৈয়দ শফিকুল হক বলেন, চরে যেহেতু বর্ষার সময় কোনো মানুষ থাকে না। সবাই মেইনল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বা এলাকায় থাকে। এছাড়া চরে ২১টি মহিষের টিলা ও মাছের আড়ত আছে। তাই সেখানে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা নির্বাচনের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্তরা গিয়ে থাকতে পারবে না। তাই আমরা এসব দেখে কমিশনের কাছে মেইনল্যান্ডে নির্বাচন করার অনুমতি চেয়েছি এবং কমিশন অনুমতি দিয়েছে।

মহিষের ঘর আর মাছের আড়ত নিয়ে একটি ইউনিয়ন হয় কি না জানতে চাইলে সৈয়দ শফিকুল হক বলেন, ‘এটা দেওয়া আছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করেছে। তার প্রতিনিধি আমরা নির্বাচন করবো। তারা বন্ধ করে দিলে নির্বাচন করব না।’

জানা গেছে, হাজীপুর ইউনিয়নে দুজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। সংরক্ষিত মহিলা আসনে প্রার্থী ১০ জন। সাধারণ মেম্বারপদপ্রার্থী ২৩ জন। এর মধ্যে ৪ এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ডে একজন করে প্রার্থী থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

হাজীপুর ইউনিয়ন অন্তত ৩০ বছর আগে মেইনল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিছুটা অংশ ছিল ২০১৯ সালে। হেঁটে ছোট্ট খাল পার হয়ে যাওয়া যেত হাজীপুর ইউনিয়নে। এমনটাই জানালেন ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, সময়ের বিবর্তনে আজ তা ভয়াল মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। রয়েছে শুধু ছোট্ট একটু চর। সেটাও কখনো ডুবে থাকে, কখনো ভেসে ওঠে। তবে আমার সময় প্রায় ২ হাজার ৮০০ ভোটার ছিল। চরে দুটি গুচ্ছগ্রামসহ অন্তত প্রায় ৪শ পরিবারের বসবাস ছিল।

সাবেক ৩ নম্বর আর বর্তমান ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মো. শাহে আলম মাঝি। হাজীপুরের ভোটার হলেও ইউনিয়ন বিলীন হয়ে যাওয়ায় বসবাস করছেন সৈয়দপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নুর মিয়ারহাট বাজারের পাশে। ৬৫ বছরের এই জেলে বলেন, ‘ছোট বেলায় ফুটবল খেলতাম আর আজ সেই গ্রাম মেঘনার মাঝখানে। শুধু একটা মহিষ থাকার মাটির টিলা ছাড়া ইউনিয়ন বলতে কিছু নেই। সেখানে মানুষের কোনো বসবাসের চিহ্ন নেই। থাকে কিছু মহিষ।’