বাজারে ডলারের সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। বাড়তি দামেও খোলা বাজারে চাহিদামতো ডলার মিলছে না। খোলাবাজারে একদিনের ব্যবধানে ডলারের দাম রেকর্ড ছয় থেকে আট টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এক ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১১ থেকে ১১২ টাকায়। এর আগে কখনও ডলারের দাম এতো বেশি উঠেনি। আগের দিন সোমবারও খোলা বাজারে এক ডলারের দাম ছিল ১০৪ থেকে ১০৬ টাকা। দাম বৃদ্ধির এমন রেকর্ডে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিল ও পল্টন এলাকার বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জার ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।
কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, খোলা বাজারে তীব্র সংকট রয়েছে ডলারের। ব্যাংকের মতো খোলাবাজারেও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশী পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম।
এই প্রসঙ্গে যমুনা মানি এক্সচেঞ্জের স্বত্বাধিকারী আনিসুজ্জামান বলেন, বাজারে ডলারের তীব্র সংকট রয়েছে। কিছু মানুষ ডলার মজুদ করে রেখেছে এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, আমরা বেশি দাম দিয়েও ডলার কিনতে পারছি না। ফলে গ্রাহকদেরও চাহিদা মত ডলার সরবরাহ করতে পারছি না। চাহিদা মত গ্রাহকের ডলার দিতে না পারায় অফিস বন্ধ করে দিয়েছি। খোলা বাজারে ১১২ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অথচ একদিন আগেও ১০৫ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানের ডলার প্রতি দাম বেড়েছে ৭ টাকার মত। যা অথীতে আর কখনও এমনটি দেখা যায়নি।
একদিনের ব্যবধানে এত দাম বাড়ার কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে ডলারের দাম উন্মুক্ত করে দেয়ার পর দাম বাড়ছেই। আর চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ডলার নেই। অনেকে ডলার কিনে ধরে রাখতে চাইছে। অনেকে ডলার কিনতে এলেও সবাইকে দেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, তেলের মত ডলারও কোন কুচক্রি মহল মজুদ করছে কি না তা খতিয়ে দেখার দরকার। বাজারে ডলারের হাহাকার চলছে। ডলারের মত তুলে দেয়ার কারণেই এমন হয়েছে। আর এ কারণেই কারো হাতে নিয়ন্ত্রণ নেই। অবশ্যই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । তা না হলে বাজারে আরও সংকট প্রকট হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খোলাবাজার থেকে যে কেউ ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। যে কারণে অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে শেয়ারবাজারের মতো বিনিয়োগ করছেন, যা অবৈধ। কিন্তু খোলাবাজারে ডলার কেনা-বেচায় তেমন আনুষ্ঠানিকতার বালাই নেই। এ কারণে ব্যাংকের চেয়ে দর বেশি হলেও খোলা বাজার থেকে ডলার সংগ্রহ করেন বিদেশগামী অনেক যাত্রী। ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরত আসা ব্যক্তি ও পর্যটকরা বেশি দামের আশায় কাগুজে ডলার খোলা বাজারে বিক্রি করে দেন।
এর আগে খোলাবাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দর উঠে গত রোববার। ওইদিন খোলাবাজারে ডলারের দর ১০৫ টাকায় উঠেছিল। সেখান থেকে সোমবার আবার এক টাকা কমে ১০৪ টাকায় বিক্রি হয়। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সেও ডলারের দর অনেক বেড়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমছে। সোমবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর আরও ২৫ পয়সা বেড়েছে। প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলো এই দরে ডলার কিনেছে। গত একবছরে আন্তঃব্যাংক দর ৯ টাকা ৯০ পয়সা বেড়েছে।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার শুরু পর বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়, বাড়তে থাকে দাম।
বাজার স্থিতিশীল করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত ৭০ কোটির বেশি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে।
হজযাত্রীদের ফেরার এ সময়ে খোলা বাজারে ডলারের ভালো সরবরাহ থাকার কথা থাকলেও এবার সংকট দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে ডলার বিক্রি করতে আসা ব্যক্তিদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। রাজধানীর পল্টন এলাকার একটি ভবনে অনেকগুলো মানি এক্সচেঞ্জ অফিস রয়েছে, ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই কর্মীরা জানতে চাইছেন, ডলার আছে কি না। সংকটের এ বাজারে ডলারে দর আরও বাড়বে নাকি- কমবে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন মানি এক্সচেঞ্জের কর্মীরা।
মেক্সিমকো মানি এক্সচেঞ্জের বিক্রয়কর্মী মো. রুবেল সরকার জানিয়েছেন, ডলারের নির্দিষ্ট কোনো দর তারা ক্রেতাদের বলতে পারছেন না। ফোন করে অনেকেই কিনতে আসেন। তাদের এখন বলছেন, বাজারে এসে দর দেখতে।
সব দোকান থেকেই ফোন করা হচ্ছে ডলার কার কাছে আছে জানতে। অনেকেই ডলার মজুদ করে রাখে,ফোন দিলে লোক পাঠায়া দেয়। কিন্তু তারাও দিতে পারতেছে না।
ডলার নিয়ে অতীতে আর কখনও এমন হযবরল অবস্থা দেখা যায়নি। এ ফলে আমদানি করা সব ধরনের পণ্যের দামই বাড়ছে। সরকার ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে বিদেশ সফর প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বিলাস পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে। তারপরেও কোন কাজে আসছে না দাম বেড়েছে চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ^াস করে। তাই না ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে না। একইভাবে এই নিয়ন্ত্রণকারী ব্যাংকটি সুদে হারও তুলে দিতে চাচ্ছে। শুধু তাই নয় তারা খেলাপির দায়ও ব্যাংকগুলোর উপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে করে খেলাপির সংখ্যা বেড়ে যাবে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। আর মুদ্রা বাজার ঠিক রাখা। তারা যদি বৈদেশিক মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণই না করেন তাহলে তাদের কাজ কি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাজারে আরও বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।