চসিক নির্বাচনে জিততে মরিয়া ১৬ বিদ্রোহী প্রার্থী। (ধারাবাহিক পর্ব-০১)

গত ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ সালে সাবেক মেয়র ও বর্তমান চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আ জ ম নাছিরকে সরিয়ে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দল এম রেজাউল করিম চৌধুরীর নাম মেয়র প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত ঘোষনা দেবার পর থেকে বর্তমান বিদ্রোহী প্রার্থীদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। দু’ তিন জন বিদ্রোহী প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করলেও বাকিরা সবাই নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন।
তাই, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে সন্ত্রাসী, ক্যাসিনো কেলেংকারীর সাথে জড়িত মামলার আসামী, মাদক ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, পাহাড়খেকো, দখলবাজ ও খুনের মামলার আসামি কাউন্সিলর প্রার্থীরা শক্তি প্রদর্শনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এবারের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থীদের ১৬ বিতর্কিত প্রার্থী পুলিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
আজকের প্রতিবেদনে আমাদের চট্টগ্রাম প্রতিবেদকের সরজমিন প্রাপ্ত তথ্য থেকে নগরীর ১৬ জন প্রার্থীর ৫ প্রার্থীকে নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১ম পর্বঃ
১) আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের (২৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক কমিশনার ও বর্তমান বিদ্রোহ প্রার্থী):
তিনি ২৮ নং পাঠানটুলির সাবেক কাউন্সিলর এবং বর্তমান নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। এবার চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন।
নগর রাজনীতিতে তিনি সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে সাতটি খুনসহ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও অপহরণের ২৯টি মামলা ছিল। এর মধ্যে সাক্ষীরা ভয়ে সাক্ষ্য না দেওয়ায় ২৩টি মামলায় খালাস পান তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে চারটি খুনেরসহ পাঁচটি মামলা। মামলা থেকে রেহাই পেয়ে তিনি যেন আরো গতি পান।
আবদুল কাদের আবার আলোচনায় এসেছেন নির্বাচনী সহিংসতার খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে। এবারের সিটি নির্বাচনে দল থেকে সমর্থন না পেয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা শুরুর পাঁচ দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার রাতে তার এলাকা পাঠানটুলীর মগপুকুরপাড় এলাকায় দল মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় তার অনুসারীদের। এতে আজগর আলী ওরফে বাবুল নামের এক মহল্লা সরদার নিহত হন। আজগর ছিলেন বাহাদুরের সমর্থক। আজগরের পরিবার ও প্রার্থী বাহাদুরের দাবি, বাহাদুরের পক্ষে কাজ করায় পরিকল্পিতভাবে আজগরকে হত্যা করা হয়েছে। এমন সহিংসতায় শঙ্কায় আছেন কাদেরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও এলাকার মানুষেরা।
জানা যায়, মোগলটুলী বাজারে মাছ কাটতেন বলে মাছ কাদের হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। আশির দশকে কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজেই একটি অংশের নেতৃত্বে চলে যান।
২০০০ সালের ১ এপ্রিল গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৮ এপ্রিল কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনের আগে আ জ ম নাছিরকেই গুরু মেনে কাউন্সিলর নির্বাচন করেন কাদের। নির্বাচিত হয়ে ভালো মানুষের মুখোশ পরলেও এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আবারও স্বরূপে ফিরেছেন।
১৯৯৭ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র শফিউদ্দিন আজাদকে গুলি করে হত্যা করেন মাছ কাদের।
১৯৯৮ সালের ৭ অক্টোবর চাঁদা না পেয়ে নগরের ডবলমুরিং ক্রাউন কোম্পানির বাড়ির সামনে এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন সন্ত্রাসী মাছ কাদের।
১৯৯৯ সালের ২ মার্চ পাঁচলাইশ পলিটেকনিক এলাকার ফারজানা হোটেলে পলিটেকনিক ইনস্টিউিটের এক ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করেন।
২০০০ সালের ৯ জানুয়ারি ঈদের দিন ডবলমুরিং মোগলটুলী এলাকায় ব্যবসায়ী আহাম্মদ আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২০১৪ সালে এ চারটি হত্যা মামলাসহ পাঁচটি মামলা থেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় রেহাই পান সন্ত্রাসী মাছ কাদের। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়ও ছিল আবদুল কাদের ওরফে মাছ কাদের।
আদালত সূত্র জানায়, নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত ইনামুল হক দানু, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কাদেরের নাম মামলা থেকে প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করেন। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখায় আবেদন করা হয়।
এ ব্যাপারে আ জ ম নাছির উদ্দীন গণমাধ্যমকে জানান, ‘রাজনীতি করলে মামলা থাকতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা–নেত্রীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।’ অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুনের মামলা প্রত্যাহার করতে সুপারিশ করা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এগুলো ষড়যন্ত্রমূলক। প্রত্যাহারযোগ্য হওয়ায় প্রত্যাহার হয়েছে।’ র্যাব-পুলিশের তালিকায় কাদেরের নাম থাকা বিষয়ে আ জ ম নাছির বলেন, ‘অনেক ভালো মানুষের নামও অনেক সময় যুক্ত করে দেয় তারা।’
আজগর খুনের পর নগর আওয়ামী লীগ আবার গত বুধবার রাতে জরুরি সভা করে সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিদ্রোহীরা অনড় থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। জানা যায়, ৩৪ ওয়ার্ডে ৮০ জনের বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন।
২) লায়ন মোঃ ইলিয়াছ (২৬ নং ওয়ার্ড উত্তর হালিশহর আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী):
লায়ন মোঃ ইলিয়াছ ২৬ নং ওয়ার্ড থেকে এবার চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) হয়ে দল মনোনীত প্রার্থী মোঃ হোসেন এর বিপক্ষে নির্বাচন করছেন এবং এখন পর্যন্ত নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন।
মূলতঃ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লায়ন মোঃ ইলিয়াছের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোন মামলা নেই। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী কিংবা রাজনৈতিক মামলা না থাকলেও ওনি এবারের চসিক নির্বাচনে জনসম্মুখে এসেছেন অন্য কারনে।
এবারের নির্বাচনে লায়ন মোঃ ইলিয়াছের জন্য কাজ করছেন আলোচিত ক্যাসিনো মাসলা সহ বহু মামলার আসামী ও মাদক সেবী মহানগর যুবলীগ আহবায়ক কমিটির বর্তমান সদস্য ক্যাডার সালেহ আহমদ দীঘল। ২৬ নং ওয়ার্ডে তার রয়েছে বিশাল কিশোর গ্যাং। সালেহ আহমেদ দীঘল তার কাছে লাইসেন্স করা অস্ত্রটি প্রশাসনের কাছে জমা দেননি বলে জনশ্রুত আছে। বর্তমান নির্বাচন কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে লায়ন ইলিয়াছ দীঘলকে প্রতিদিন ৩০০০ টাকা এবং মিটিং গনসংযোগ থাকলে প্রতিদিন ৫০০০ টাকা করে দিচ্ছেন বলে লায়ন মোঃ ইলিয়াছের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়।
এছাড়াও লায়ন ইলিয়াছকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছেন যুবলীগের আরেক নেতা মোঃ ওমর ফারুক। মোঃ ওমর ফারুক বর্তমানে জামিনে থাকা ধর্ষন মামলার আসামী। এলাকার বি-ব্লকে তার রয়েছে বিশাল একটি কিশোর গ্যাং।
লায়ন মোঃ ইলিয়াছকে এ নির্বাচন সহযোগীতা করছে উত্তর হালিশহরে এ-ব্লকে বসকাসকারী আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ভয়ংকর সদস্য মোঃ মিল্টন।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে লায়ন মোঃ ইলিয়াছের নিজেস্ব কোন কিশোর গ্যাং না থাকলেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সব কিশোর গ্যাং গুলো লায়ন মোঃ ইলিয়াছের অর্থায়নে পরিচালিত করছে স্ব স্ব গ্যাংয়ের নেতারা। প্রতিদিন লক্ষ্যাধিক টাকা ব্যয় করছেন এসব কিশোর গ্যাং নেতা ও গ্যাং সদস্যদের পিছনে।
জানা যায়, সাধারন ঠিকাদার হয়েও লায়ন মোঃ ইলিয়াছ কোটি কোটি টাকার মালিক। হালিশহর বারনীঘাটে বিলাশবহুল বাগানবাড়ী সহ তার রয়েছে বেশকটি বাগানবাড়ী। হালিশহর সমুদ্রপাড়ে রয়েছে তার একরে একরে জমি। ইলিয়াছের নামে মধ্যম হালিশহর ওমর শাহ পাড়া, মইন্যা পাড়া, পতেঙ্গা সহ বেশ কয়েক জায়গায় বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন বিল্ডিং রয়েছে।
তবে লায়ন মোঃ ইলিয়াছের ধনী হবার উত্থানের পেছনে তার আপন শ্বশুরের বড় রকমের অবদান আছে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা যায়। জানা যায়, তার আপন শ্বশুর পদ্মা অয়েল কোম্পানীর সাধারন চাকুরিজীবী ছিলেন। কিন্তু, তেল কেলেংকারীর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারনে বিগত ১/১১ সময় তাকে পদ্মা ওয়েলের চাকুরি থেকে ওএসডি করা হয়। তবে চাকুরিতে থাকা অবস্থায় অবৈধ ভাবে তেল বিক্রি থেকে কোটি কোটি টাকার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। জনশ্রুত আছে শ্বশুরের অবৈধভাবে অর্জিত টাকা লায়ন মোঃ ইলিয়াছ তার ব্যবসা ও নির্বাচনে ব্যবহার করে আসছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, লায়ন মোঃ ইলিয়াছের আপন বড় চাচা বর্তমান ২৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজী সাবের এই চসিক নির্বাচনে সরাসরি ইলিয়াছের বিপক্ষে অবস্থান করছেন। তিনি বর্তমান আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোঃ হোসেনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
বর্তমানে চসিক নির্বাচনে লায়ন মোঃ ইলিয়াছ দলীয় প্রার্থী মোঃ হোসেনর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িঁয়েছেন। সাধারন ভোটারদের মতে গতবারের মতো আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর যুদ্ধে এবারোও হয়তো বিএনপি সমর্থিত আবুল হাশেম জয়ের মুকুট পড়ে দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন।
৩) এসরারুল হক ওরফে এসরাল (৪ নং চান্দগাঁও ওয়ার্ড)
আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাইফুদ্দিন খালেদ এর বিপক্ষে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের কম করে হলেও ১০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী এ ওয়ার্ড থেকে নির্বাচন করছে। তাদের একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী যুবলীগ নেতা এসরারুল হক এসরাল।
এসরারুল হক ওরফে এসরাল চান্দগাঁও-বহদ্দারহাট এলাকায় ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও দাপুটে চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। তিন দফা জেলও খেটেছে সে। তবে এলাকাবাসীর মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী যুবলীগ লীগ নেতা পরিচয় ও চাঁদাবাজি করে তোলা বিপুল অংকের অর্থের ভাগ পুলিশকে দিয়ে বর্তমানে দোর্দণ্ড প্রতাপে চলাফেরা করছে সে।
চান্দগাঁও থানা এলাকায় সবচেয়ে বড় চাঁদার স্পট ব্যস্ততম বহদ্দারহাট এলাকা। বহদ্দারহাট ফুটপাত দখল করে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০০ দোকান। বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে ভাসমান দোকানের প্রতিটি থেকে দৈনিক সর্বনিু ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নেয়া হয়। ফরিদারপাড়া মাজার গলি ও বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে রয়েছে দুটি বড় মাদক স্পট। এসব থেকে চাঁদা তোলে এসরাল বাহিনী।
এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ, কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকায় রয়েছে প্রায় তিনশ’ গার্মেন্ট কারখানা। এসব গার্মেন্ট থেকে বের হওয়া বৈধ-অবৈধ ঝুটের গাড়ি প্রতিটি থেকে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে এসরালের লোকজন।
চট্টগ্রামে আমজাদ হোসেন নামে এক মুরগি ব্যবসায়ী যুবকের পা ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে দিয়েছিলো এসরাল বাহিনী।
১৯৯৮ সালে এসরাল একটি ডাকাতির ঘটনায় দুটি অস্ত্র, এগারো রাউন্ড গুলি ও লুট করা স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রথম গ্রেফতার হয়। চান্দগাঁও থানায় মামলা [০১(৪)৯৮] হয়।
২০০১ সালে বহদ্দারহাট পেপসি কোম্পানির ম্যানেজার অপহরণে মূল হোতা হিসেবেই তার নাম উঠে আসে।
২০০৪ সালে খুলশী ইস্পাহানি স্কুলের সামনে থেকে এসরালকে দুটি অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে র্যাব-৭। এ মামলায় ১৭ বছর সাজাও হয়। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। নং- ১৪(১০)০৪। কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে যায়।
পাঁচলাইশ থানা এলাকায় মিমি সুপার মার্কেটসংলগ্ন পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হামলা ও তিনটি অস্ত্র লুটের ঘটনায় প্রধান আসামি ছিল সে।
২০০৩ সালে গোলপাহাড় মোড় এলাকায় চাঞ্চল্যকর একে-২২ রাইফেল অস্ত্র উদ্ধার মামলার প্রধান আসামিও এ এসরাল। [কোতোয়ালি থানা, ৪৪(৪)০৩
২০০৬ সালে মুরাদপুরে ব্যবসায়ী আজাদ হত্যার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালে চাঁদাবাজি ও অধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের ব্রাশফায়ারে তার এক ভাইয়ের মৃত্যুর পর উত্থান হয় এসরালের। ২০০৪ সালে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় তার আরও এক ভাই। জামিনে বেরিয়ে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের এক ছাত্রীকে অপহরণের সময় চন্দনাইশ থানায় অস্ত্রসহ ফের গ্রেফতার হয় এসরাল।
৪) জহুরুল আলম জসীম (৯ নং উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী):
সাবেক এ কাউন্সিলর জসিম বর্তমানে ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। ছাত্রজীবনে পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি।
বলা যায় একদম তৃণমূল থেকে উঠে আসা এ নেতা আজকের প্রভাবশালীর উল্লেখযোগ্য অবস্থানে এসে হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। বর্তমানে ৯ নং ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচন করছেন।
জানা যায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কিশোর অপরাধী চক্রের (কিশোর গ্যাং) ৪৮ জন পৃষ্ঠপোষক বা নেতার তালিকা করে। তাঁদের মধ্যে সাতজন চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আলোচিত এই সাতজনের মধ্যে দুজন সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থী। বাকি পাঁচজন ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। তাঁরা হলেন নূর মোস্তফা ওরফে টিনু, এরসাদুল হক, আবুল হাসনাত ওরফে বেলাল, দিদারুল আলম মাসুম, সাবের আহম্মদ, জহুরুল হক ওরফে জসিম ও ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী। তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এর মধ্যে অবশ্য ১২ ও ২৫ নং ওয়ার্ডের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী সাবের আহম্মদ ও এরসাদুল হক তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন।
তাঁর বিরুদ্ধে সন্দ্বীপের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছাত্রদলের ক্যাডার বেলাল উদ্দিন জুয়েলকে আকবর শাহ থানা এলাকার যুবলীগের নেতা বানানোর অভিযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করানো হয় এবং তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এলাকায় নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত।
স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জয়বিডি২৪ কে বলেন, “কাউন্সিলর জসিম দলের নাম ভাঙিয়ে দলের সুনাম নষ্ট করছেন। কাউন্সিলরের পদে থেকেও দখলবাজি, পাহাড় কাটা, জমি দখলসহ নানা অপরাধ করেছেন। এর মাধ্যমে গত চার বছরে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।”
২০০৭ সালে ইস্পাহানি মিলস লিমিটেডে সুপারভাইজার পদে মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন জহুরুল আলম জসিম।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চাকরি ছেড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন জসিম।
২০১৫ সালে ২৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কাউন্সিলর হবার পর জসিম হয়ে উঠেন এলাকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী এক গডফাদার।
এরপর থেকে প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি এলাকায় মাদক কারবার, দখলবাজি, শত শত একর পাহাড় কেটে সরকারি খাস জায়গা অবৈধভাবে বিক্রয়, বিশ্বব্যাংক হাউজিং এস্টেটের কবরস্থান দখল করে জায়গা বিক্রয়, অটোরিকশা-বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায়, কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেটের ১৬০টি দোকানঘর দখলসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন।
সেভেন মার্কেট বাজার, যা কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেটের মালিকানাধীন, সেখানে ১৬০টি দোকান কাউন্সিলর জসিমের দখলে রয়েছে। প্রতিটি দোকানের দখল এককালীন এক লাখ টাকা করে মোট এক কোটি ৬০ লাখ টাকায় হস্তান্তর করেছেন। এসব দোকানের প্রতিটি থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে আদায় হয়। অর্থাৎ মাসে আট থেকে ৯ লাখ টাকা আদায় হয়। সেভেন মার্কেট অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন জসিম। মাসে যার পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ টাকা। জসিম তাঁর কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকায় দখলবাজি, প্রভাব বিস্তার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তার বর্তমান সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরতে গেলে চক্ষু কপালে উঠবে। সরজমিনে প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা যায়, বর্তমানে নামে-বেনামে তাঁর ৩০০-৪০০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক কলোনিতে ১৭টি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা;
ফিরোজ শাহ কলোনিতে ছয়টি প্লট ও দুটি ছয়তলা বাড়ি, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা;
গিরিধারা হাউজিংয়ে সাত কাঠা সমমানের চারটি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১০ কোটি টাকা;
জয়ন্তিকা আবাসিকে ১৩টি প্লট, যার বাজারমূল্য আট থেকে ১০ কোটি টাকা;
লেকসিটি হাউজিংয়ে ছয়টি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা;
লেকসিটি হাউজিংয়ের পাশে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে বিভিন্ন দাগে মোট ২০ কানি (৪০০ গণ্ডা) জায়গা দখল, যার বাজারমূল্য ৮০-৯০ কোটি টাকা;
হারবাতলী শাপলা আবাসিক এলাকায় অন্তত ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি দৃশ্যমান।
৫) তৌফিক আহমেদ চৌধুরী (১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী):
তিনি নগর যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য, যুবলীগ সভাপতি ১ নং দক্ষিন পাহাড়তলী ওয়ার্ড, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও চলমান চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী।
বিভিন্ন ঘটনায় একাধিক মামলা থাকলেও বর্তমানে জামিনে আছেন কাউন্সিলর তৌফিক। দেশব্যাপী সরকারের শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে স্থলপথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত হয়ে দুবাই পালিয়ে যান তিনি। তবে শুদ্ধি অভিযানের গতি খানিকটা স্তিমিত হলে পড়ে আবারও চট্টগ্রামে ফিরে আসেন তৌফিক।
নিত্যনতুন অস্ত্র হাতে নিয়ে পরখ করে দেখা তার নেশা। তবে রাশিয়ান অস্ত্র তার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।
এই কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠরা জানান, তার কাছে ৫ লাখ টাকা দামের নিচে কোনো অস্ত্র নেই। আর এসব অস্ত্র বিদেশ থেকে চোরাই পথে আনা। ফেনী ও বেনাপোল সীমান্তে অস্ত্রের কারবার নিয়ন্ত্রণকারী একটি গ্রুপ এবং নারায়ণগঞ্জের একটি সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের সঙ্গে তার সখ্য দীর্ঘদিনের। তবে তিনি ফোনে কোনো অস্ত্রের কারবারের কথা বলেন না। কোনো মাধ্যমে নয়, শুধু মুখোমুখি সাক্ষাতে সরাসরি ক্রেতার কাছে অস্ত্র বিক্রি করেন তৌফিক। এজন্য নগরীর ফতেয়াবাদ, আমানবাজার ও খোশালশাহ মাজার এলাকার রয়েছে তার আলাদা তিনটি আস্তানা। বর্তমানে তার কাছে রয়েছে লাইসেন্স করা একটি একে-২২ সেমি অটোমেটিক রাইফেল এবং একটি নাইন এমএম রিভলবার। তবে এর বাইরেও তৌফিকের কাছে সব সময় অত্যাধুনিক ৫ মিটার রেঞ্জের ক্ষুদ্রাকৃতির একটি অবৈধ পিস্তল থাকে। যা শার্টের পকেটেই রাখা যায় অনায়াসে। এই অস্ত্রটি এতই ক্ষুদ্রাকৃতির, প্রথম দেখায় কেউ বুঝতেই পারবে না যে তার কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র আছে। চট্টগ্রামের অপরাধজগতের বেশিরভাগ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ তৌফিকের বিরুদ্ধে।
২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের বড়দীঘিপাড় এলাকায় একটি প্রাইভেট কারে তল্লাশি চালিয়ে রাইফেল ও ৫৬ রাউন্ড গুলিসহ শফিউল বশর ওরফে রনি এবং সোহেল রানা নামে তৌফিকের দুই অনুসারীকে গ্রেপ্তার করে র্যাবের একটি দল।
গত ৫’মে ২০১৬ সাল রাত ৯ টায় নূর এলাহী নামে এক যুবলীগ কর্মী খুন হওয়া মামলার ১ নং আসামী তৌফিক আহমেদ চৌধুরী।
তখন পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ আদালতে কাউন্সিলর তৌফিককে আসামি করে চার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে বলা হয়, ‘হাটহাজারীর মির্জাপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল আফছারের নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে ২০১৬ সালের ৫ মে বিকেলে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা শেষে সন্ধ্যায় সরকার হাট বাজারে নির্বাচনী কার্যালয়ের সামনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন নুরে এলাহীসহ ছয় থেকে সাতজন। ঘন্টা খানেক পর সেখানে আসেন কাউন্সিলর তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। একপর্যায়ে তিনি তাঁর হাতে থাকা একটি পিস্তল দেখিয়ে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ করে বলেন, নতুন অটোমেটিক অস্ত্র কিনেছেন। অনেক গুলি লোড করা যায়। এ সময় তৌফিক দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়েন। নিচের দিকে আরেকটি ছোড়ার সময় নুরে এলাহীর গায়ে পড়ে। মূহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তৌফিক ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত সরে পড়েন। ওই দিন রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান নুরে এলাহী। তিনি পলাতক থাকায় ঘটনায় ব্যবহৃত ৭ দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তলটি উদ্ধার করা যায়নি।”
দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে হাটহাজারি থানায় ১ খুনের মামলা রয়েছে।
এছাড়া কোতয়ালী থানায় একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে।
৫ বছর আগে হাটহাজারীর ছিপাতলীতে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর ভোটকেন্দ্র দখলের জন্য ৫০ জন অনুসারীকে দুটি এলজি ও একটি পিস্তল দিয়ে পাঠান তৌফিক। পরে স্থানীয় জনতার প্রতিরোধে পালিয়ে আসে তার অনুসারীরা।
উল্লেখ্য যে, অস্ত্র ও হত্যা মামলায় জামিনে থাকা চট্টগ্রাম নগর ও জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ সন্ত্রাসী তৌফিকের অস্ত্র ভাড়া ও বিক্রি করে এটা ওপেন সিক্রেট। নগরী ও জেলার অবৈধ অস্ত্রের জোগানদাতা সে। অস্ত্রগুলো অত্যাধুনিক হওয়ায় তৌফিকের কদর বেশি। এ ছাড়া নির্বাচনে তার অস্ত্রের ব্যবহার তো পুরনো। এই জেলায় বিশেষ করে রাশিয়ান অস্ত্রের বিক্রেতা সে।