০৩:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ মার্চ ২০২৪, ৮ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গৃহযু‌দ্ধের প‌থে মিয়ানমার!

  • Reporter Name
  • Update Time : ০১:০০:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • 29

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন সংগঠিত সশস্ত্র বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। এক বছর আগে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অনেক তরুণ জীবনবাজি রেখে লড়াই করছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে।

সহিংসতার মাত্রা এবং হামলাগুলোর মধ্যকার সমন্বয় দেখে মনে হয় সংঘাত ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে গৃহযুদ্ধে। সংঘাত মনিটর করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট বা অ্যাকলেড বলছে সহিংসতা এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। খবর বিবিসি বাংলার।

এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে যেসব রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তাও বলছে লড়াইগুলোর মধ্যে সমন্বয় বেড়েছে এবং শহর এলাকায় পৌঁছে গেছে যা সামরিক বাহিনীর মধ্যে আগে দেখা যায়নি।

নিহতের সংখ্যা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত যদিও যাচাই করার সুযোগ কম। তবে অ্যাকলেড বলছে ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।

স্থানীয় গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে এ তথ্য দিয়েছে অ্যাকলেড। তারা বলছে আগস্ট থেকে সংঘর্ষগুলো রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অভ্যুত্থানের পরপরই বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল সামরিক বাহিনীর অভিযানে।

আর এখন লোকজন মারা যাচ্ছে সরাসরি লড়াইয়ে। অর্থাৎ বেসামরিক নাগরিকরা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট বিবিসিকে বলেছেন, মিয়ানমারের সংঘাতকে এখন গৃহযুদ্ধ বলা উচিত এবং তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাপ প্রয়োগের জন্য আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। তিনি সেখানকার পরিস্থিতিকে বিপর্যয়কর উল্লেখ করে এই সংঘাতকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে সতর্ক করেছেন।

সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সেখানে যেসব গোষ্ঠী লড়াই করছে তারা পরিচিত হয়ে উঠেছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স বা পিডিএফ নামে। এটি মূলত বেসামরিক মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর মধ্যকার একটি নেটওয়ার্ক।

আঠারো বছর বয়সী হেরা (ছদ্মনাম) যখন সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন, তখন তিনি মাত্র হাই স্কুল শেষ করেছেন।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চিন্তা স্থগিত রেখেছেন কারণ মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে একটি পিডিএফ প্লাটুনের কমান্ডার তিনি। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে একজন ছাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টির পর তিনি বিক্ষোভে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হন।

হেরার বাবা প্রথম প্রথম খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন যখন তাদের কন্যা পিডিএফ কমব্যাট প্রশিক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু পরে তারা যখন বুঝতে পারেন যে মেয়ে বিষয়টি নিয়ে খুবই সিরিয়াস তখন তারা মেনে নেন। ‘তারা আমাকে বলেছেন, তুমি যদি এটি করতে চাও আসলেই, তাহলে শেষ পর্যন্ত করো। মাঝপথে ছেড়ে দিওনা। আমি আমার প্রশিক্ষকের সঙ্গে কথা বললাম ও প্রশিক্ষণের পাঁচ দিনের মাথায় পুরোপুরি বিপ্লবেযোগ দিলাম।’

সামরিক অভ্যুত্থানের আগে হেরার মতো মানুষেরা একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখেই বড় হচ্ছিলেন।

সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণে তারা ব্যাপকভাবে অসন্তুষ্ট হন এবং বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী পরিচালিত মিলিশিয়াগুলোর সমর্থন ও প্রশিক্ষণ পেতে শুরু করে সীমান্ত এলাকাগুলোতে। এসব গোষ্ঠী দশকের পর দশক ধরে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ: বিবিসি অ্যাকলেড থেকে তথ্য নিয়েছে। এটি একটি অলাভজনক সংস্থা যারা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিক্ষোভের তথ্য সংগ্রহ করে।

তারা গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও সিভিল সোসাইটি প্রকাশনা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরাপত্তা সম্পর্কে যেসব রিপোর্ট দেয় সেগুলোর ভিত্তিতে তথ্য পেয়ে থাকে।

তবে অ্যাকলেড প্রতিটি সংবাদ নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করে না। তারা বলে যে, হতাহত সম্পর্কিত তাদের তথ্যাদি প্রতিনিয়ত আপডেট করা হয় নতুন করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। কারণ একটি সংঘাতময় এলাকা থেকে সবকিছুর তথ্য পাওয়া কঠিন। কারণ এসব তথ্য অনেক সময় পক্ষপাতমূলক ও অসমাপ্ত হয়ে থাকে।

উভয়পক্ষই যেখানে প্রচারণায় জড়িত সেখানে সত্যিকার চিত্র পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব। সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারও এসব এলাকায় সীমিত।

বিবিসি বার্মিজ সার্ভিস ২০২১ সালের মে-জুনে পিডিএফ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষে হতাহতদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিল যা অ্যাকলেডের তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

পিডিএফ গঠিত হয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমন্বয়ে যেখানে আছেন কৃষক, গৃহিণী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী। তারা সামরিক জান্তাকে উৎখাতের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

সারাদেশেই তারা এক হয়েছে। কিন্তু বার্মার জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের এই বিক্ষোভে যুক্ত হবার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এবারই প্রথম সেনাবাহিনী বার্মাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মিস ব্যাশেলেট বিবিসিকে বলেন, অনেক বেসামরিক নাগরিক এসব মিলিশিয়া বা কথিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দিচ্ছে।

এজন্যই অনেকদিন ধরেই আমি বলছি যে আমরা যদি আর কঠিন কিছু করতে না পারি তাহলে এটা আসলে সিরিয়া পরিস্থিতির মত হবে।

সাবেক ব্যবসায়ী নাগার। সাগাইং অঞ্চলে তিনি কয়েকটি পিডিএফ ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন যে, এটা কোনো সমান লড়াই নয়। গুলতি দিয়ে শুরু করে এখন তারা নিজেরা বন্দুক ও বোমা বানাচ্ছে। অথচ ব্যাপক ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনী সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিমান হামলা করছে। তারা রাশিয়া ও চীন থেকে অস্ত্র কিনতে পারছে।

মিয়ানমার উইটনেস ও বিবিসির একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, রুশ সাঁজোয়া যান সেখানে এসেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। কিন্তু পিডিএফের শক্তি হলো স্থানীয়দের মধ্যে এর প্রতি সমর্থন। যা তৃণমূলের প্রতিরোধকে সংগঠিত রূপ দিয়েছে।

দেশটির নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকার কিছুটা সহায়তা করেছে এবং কিছু পিডিএফ ইউনিটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ রাখছে।

পিডিএফের টার্গেট হলো সরকারি বাহিনী। যেমন পুলিশ স্টেশন বা কম লোকবলের চৌকিগুলো। তারা অস্ত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং সামরিক জান্তার মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বোমা মারছে। এর মধ্যে আছে টেলিকম টাওয়ার ও ব্যাংক।

নাগার বলছেন দেশটির ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে নেয়া ছাড়া পিডিএফের আর কোনো উপায় নেই। ‘আমি মনে করি আলোচনায় আর সমাধান হবে না। বিশ্ব আমাদের দেশকে উপেক্ষা করছে। সেজন্যই আমি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি।’

হেরা, যিনি তার বোনদেরসহ পিডিএফে যোগ দিয়েছেন, বলছেন তাদের লক্ষ্য হলো সামরিক স্বৈরাচারকে উৎখাত করা। ‘সেনাবাহিনী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। তারা মানুষের জান মাল ধ্বংস করছে এবং তারা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এটা আমি মেনে নিতে পারি না।’

সামরিক বাহিনীর হাতে গণহত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। জুলাইতে অন্তত ৪০ জন এবং ডিসেম্বরে নারী ও শিশুসহ ৩৫ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন।

এমন ঘটনায় বেঁচে আসা একজনের সঙ্গে বিবিসি কথাও বলেছে। নাগাথিন এলাকার একটি গ্রামে সেনাবাহিনী প্রবেশের পর পালাতে না পারা ছয় জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বয়স্ক আর দুজন ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ। যারা বেঁচেছেন তারা বলেছেন যে সামরিক বাহিনী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের খুঁজছিল।

নিহতদের একজনের স্ত্রী বলছিলেন তার স্বামীর শরীরে ছিলো নির্যাতনের চিহ্ন। ‘তারা একজন বয়স্ক মানুষকে খুন করল যিনি এমনকি ঠিকমতো সব বুঝিয়ে বলতেও পারে না। আমি এটা ভুলব না। যখনি মনে পড়ে এটা আমার কান্না পায়,’ বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।

সেনাবাহিনী সাক্ষাৎকার দেয় এমন নজির খুব কম। কিন্তু ২০২১ সালের শেষের দিকে জান্তা মুখপাত্র জ মিন তুন বিবিসিকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে পিডিএফকে সন্ত্রাসী হিসেবে বর্ণনা করেন।

‘তারা যদি আমাদের ওপর আক্রমণ করে, আমরা সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছি উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য। আমরা দেশকে এবং অঞ্চলকে সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট। যৌক্তিক পর্যায়ে নিরাপত্তা বিধান করতে আমরা যথোপযুক্ত শক্তি প্রয়োগ করছি’, তিনি বলেন।

কোন পক্ষে কত জন লড়াই করছে তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে আনুষ্ঠানিক সদস্য সংখ্যা তিন লাখ সত্তর হাজার। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক কম হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ তেমন একটা হয়নি। তাছাড়া অভ্যুত্থানের পর অনেকে পক্ষত্যাগও করেছেন। একইভাবে পিডিএফের সদস্য সংখ্যারও সঠিক হিসেব পাওয়া কঠিন।

পাশাপাশি এনইউজি-র গঠন করা ইউনিটগুলো ছাড়াও সীমান্তে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে কিছু পিডিএফ সদস্য প্রশিক্ষণ, আশ্রয় এবং এমনকি অস্ত্রশস্ত্রও পেয়েছে। কিছু কিছু গোষ্ঠী পূর্ববর্তী সরকারের সাথে অস্ত্র বিরতি চুক্তিও করেছিল, যে চুক্তিগুলো এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এই জাতিগত গোষ্ঠীগুলো দেশকে ধ্বংস করতে চায় – সেনাবাহিনীর এমন প্রচারণা বিশ্বাস করার জন্য পিডিএফ এখন তাদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে।

পিডিএফ এখন এমন একটি ভবিষ্যৎ কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার কথা বলছে যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে।

একজন নান – যিনি ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর বিক্ষোভকারীদের রক্ষা করতে পুলিশের সামনে হাঁটু গেড়ে অবস্থান নেয়ার কারণে আলোচনায় এসেছিলেন, তিনি বিবিসিকে বলেন, অভ্যুত্থানের পর যে রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ হয়েছে জনজীবনে তার একটা ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

সিস্টার অ্যান রোজ নু তং বলেন, ‘শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, অর্থনীতি ও জীবিকা – সবকিছুই ভেঙ্গে পড়েছে।’

‘ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে সন্তান প্রতিপালন করতে অক্ষম হয়ে পড়ায় কেউ কেউ গর্ভপাত করিয়েছেন। কারণ পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে পারছেন না কারণ তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।’

কিন্তু যেসব তরুণ-তরুণী যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তাদের প্রশংসা করেন এই নান। ‘তারা সাহসী। গণতন্ত্রের জন্য, দেশের ভালোর জন্য, শান্তির জন্য এবং দেশকে সেনাশাসন থেকে মুক্ত করার জন্য জীবন বাজি রাখতে তাদের আপত্তি নেই। আমি তাদের প্রশংসা করি। আমি তাদের জন্য গর্বিত। তাদের আমি সম্মান করি।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

গৃহযু‌দ্ধের প‌থে মিয়ানমার!

Update Time : ০১:০০:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন সংগঠিত সশস্ত্র বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। এক বছর আগে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অনেক তরুণ জীবনবাজি রেখে লড়াই করছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে।

সহিংসতার মাত্রা এবং হামলাগুলোর মধ্যকার সমন্বয় দেখে মনে হয় সংঘাত ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে গৃহযুদ্ধে। সংঘাত মনিটর করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট বা অ্যাকলেড বলছে সহিংসতা এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। খবর বিবিসি বাংলার।

এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে যেসব রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে তাও বলছে লড়াইগুলোর মধ্যে সমন্বয় বেড়েছে এবং শহর এলাকায় পৌঁছে গেছে যা সামরিক বাহিনীর মধ্যে আগে দেখা যায়নি।

নিহতের সংখ্যা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত যদিও যাচাই করার সুযোগ কম। তবে অ্যাকলেড বলছে ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।

স্থানীয় গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে এ তথ্য দিয়েছে অ্যাকলেড। তারা বলছে আগস্ট থেকে সংঘর্ষগুলো রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অভ্যুত্থানের পরপরই বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল সামরিক বাহিনীর অভিযানে।

আর এখন লোকজন মারা যাচ্ছে সরাসরি লড়াইয়ে। অর্থাৎ বেসামরিক নাগরিকরা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট বিবিসিকে বলেছেন, মিয়ানমারের সংঘাতকে এখন গৃহযুদ্ধ বলা উচিত এবং তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাপ প্রয়োগের জন্য আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। তিনি সেখানকার পরিস্থিতিকে বিপর্যয়কর উল্লেখ করে এই সংঘাতকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে সতর্ক করেছেন।

সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সেখানে যেসব গোষ্ঠী লড়াই করছে তারা পরিচিত হয়ে উঠেছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স বা পিডিএফ নামে। এটি মূলত বেসামরিক মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর মধ্যকার একটি নেটওয়ার্ক।

আঠারো বছর বয়সী হেরা (ছদ্মনাম) যখন সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন, তখন তিনি মাত্র হাই স্কুল শেষ করেছেন।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চিন্তা স্থগিত রেখেছেন কারণ মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে একটি পিডিএফ প্লাটুনের কমান্ডার তিনি। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে একজন ছাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টির পর তিনি বিক্ষোভে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ হন।

হেরার বাবা প্রথম প্রথম খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন যখন তাদের কন্যা পিডিএফ কমব্যাট প্রশিক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু পরে তারা যখন বুঝতে পারেন যে মেয়ে বিষয়টি নিয়ে খুবই সিরিয়াস তখন তারা মেনে নেন। ‘তারা আমাকে বলেছেন, তুমি যদি এটি করতে চাও আসলেই, তাহলে শেষ পর্যন্ত করো। মাঝপথে ছেড়ে দিওনা। আমি আমার প্রশিক্ষকের সঙ্গে কথা বললাম ও প্রশিক্ষণের পাঁচ দিনের মাথায় পুরোপুরি বিপ্লবেযোগ দিলাম।’

সামরিক অভ্যুত্থানের আগে হেরার মতো মানুষেরা একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখেই বড় হচ্ছিলেন।

সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণে তারা ব্যাপকভাবে অসন্তুষ্ট হন এবং বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী পরিচালিত মিলিশিয়াগুলোর সমর্থন ও প্রশিক্ষণ পেতে শুরু করে সীমান্ত এলাকাগুলোতে। এসব গোষ্ঠী দশকের পর দশক ধরে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ: বিবিসি অ্যাকলেড থেকে তথ্য নিয়েছে। এটি একটি অলাভজনক সংস্থা যারা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা ও বিক্ষোভের তথ্য সংগ্রহ করে।

তারা গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও সিভিল সোসাইটি প্রকাশনা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরাপত্তা সম্পর্কে যেসব রিপোর্ট দেয় সেগুলোর ভিত্তিতে তথ্য পেয়ে থাকে।

তবে অ্যাকলেড প্রতিটি সংবাদ নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করে না। তারা বলে যে, হতাহত সম্পর্কিত তাদের তথ্যাদি প্রতিনিয়ত আপডেট করা হয় নতুন করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। কারণ একটি সংঘাতময় এলাকা থেকে সবকিছুর তথ্য পাওয়া কঠিন। কারণ এসব তথ্য অনেক সময় পক্ষপাতমূলক ও অসমাপ্ত হয়ে থাকে।

উভয়পক্ষই যেখানে প্রচারণায় জড়িত সেখানে সত্যিকার চিত্র পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব। সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারও এসব এলাকায় সীমিত।

বিবিসি বার্মিজ সার্ভিস ২০২১ সালের মে-জুনে পিডিএফ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষে হতাহতদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিল যা অ্যাকলেডের তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

পিডিএফ গঠিত হয়েছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমন্বয়ে যেখানে আছেন কৃষক, গৃহিণী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী। তারা সামরিক জান্তাকে উৎখাতের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

সারাদেশেই তারা এক হয়েছে। কিন্তু বার্মার জাতিগোষ্ঠীর তরুণদের এই বিক্ষোভে যুক্ত হবার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এবারই প্রথম সেনাবাহিনী বার্মাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মিস ব্যাশেলেট বিবিসিকে বলেন, অনেক বেসামরিক নাগরিক এসব মিলিশিয়া বা কথিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে যোগ দিচ্ছে।

এজন্যই অনেকদিন ধরেই আমি বলছি যে আমরা যদি আর কঠিন কিছু করতে না পারি তাহলে এটা আসলে সিরিয়া পরিস্থিতির মত হবে।

সাবেক ব্যবসায়ী নাগার। সাগাইং অঞ্চলে তিনি কয়েকটি পিডিএফ ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন যে, এটা কোনো সমান লড়াই নয়। গুলতি দিয়ে শুরু করে এখন তারা নিজেরা বন্দুক ও বোমা বানাচ্ছে। অথচ ব্যাপক ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনী সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিমান হামলা করছে। তারা রাশিয়া ও চীন থেকে অস্ত্র কিনতে পারছে।

মিয়ানমার উইটনেস ও বিবিসির একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, রুশ সাঁজোয়া যান সেখানে এসেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। কিন্তু পিডিএফের শক্তি হলো স্থানীয়দের মধ্যে এর প্রতি সমর্থন। যা তৃণমূলের প্রতিরোধকে সংগঠিত রূপ দিয়েছে।

দেশটির নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকার কিছুটা সহায়তা করেছে এবং কিছু পিডিএফ ইউনিটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ রাখছে।

পিডিএফের টার্গেট হলো সরকারি বাহিনী। যেমন পুলিশ স্টেশন বা কম লোকবলের চৌকিগুলো। তারা অস্ত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং সামরিক জান্তার মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বোমা মারছে। এর মধ্যে আছে টেলিকম টাওয়ার ও ব্যাংক।

নাগার বলছেন দেশটির ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে নেয়া ছাড়া পিডিএফের আর কোনো উপায় নেই। ‘আমি মনে করি আলোচনায় আর সমাধান হবে না। বিশ্ব আমাদের দেশকে উপেক্ষা করছে। সেজন্যই আমি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছি।’

হেরা, যিনি তার বোনদেরসহ পিডিএফে যোগ দিয়েছেন, বলছেন তাদের লক্ষ্য হলো সামরিক স্বৈরাচারকে উৎখাত করা। ‘সেনাবাহিনী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। তারা মানুষের জান মাল ধ্বংস করছে এবং তারা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এটা আমি মেনে নিতে পারি না।’

সামরিক বাহিনীর হাতে গণহত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। জুলাইতে অন্তত ৪০ জন এবং ডিসেম্বরে নারী ও শিশুসহ ৩৫ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন।

এমন ঘটনায় বেঁচে আসা একজনের সঙ্গে বিবিসি কথাও বলেছে। নাগাথিন এলাকার একটি গ্রামে সেনাবাহিনী প্রবেশের পর পালাতে না পারা ছয় জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বয়স্ক আর দুজন ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ। যারা বেঁচেছেন তারা বলেছেন যে সামরিক বাহিনী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের খুঁজছিল।

নিহতদের একজনের স্ত্রী বলছিলেন তার স্বামীর শরীরে ছিলো নির্যাতনের চিহ্ন। ‘তারা একজন বয়স্ক মানুষকে খুন করল যিনি এমনকি ঠিকমতো সব বুঝিয়ে বলতেও পারে না। আমি এটা ভুলব না। যখনি মনে পড়ে এটা আমার কান্না পায়,’ বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।

সেনাবাহিনী সাক্ষাৎকার দেয় এমন নজির খুব কম। কিন্তু ২০২১ সালের শেষের দিকে জান্তা মুখপাত্র জ মিন তুন বিবিসিকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে পিডিএফকে সন্ত্রাসী হিসেবে বর্ণনা করেন।

‘তারা যদি আমাদের ওপর আক্রমণ করে, আমরা সৈন্যদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছি উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য। আমরা দেশকে এবং অঞ্চলকে সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট। যৌক্তিক পর্যায়ে নিরাপত্তা বিধান করতে আমরা যথোপযুক্ত শক্তি প্রয়োগ করছি’, তিনি বলেন।

কোন পক্ষে কত জন লড়াই করছে তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে আনুষ্ঠানিক সদস্য সংখ্যা তিন লাখ সত্তর হাজার। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক কম হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ তেমন একটা হয়নি। তাছাড়া অভ্যুত্থানের পর অনেকে পক্ষত্যাগও করেছেন। একইভাবে পিডিএফের সদস্য সংখ্যারও সঠিক হিসেব পাওয়া কঠিন।

পাশাপাশি এনইউজি-র গঠন করা ইউনিটগুলো ছাড়াও সীমান্তে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে কিছু পিডিএফ সদস্য প্রশিক্ষণ, আশ্রয় এবং এমনকি অস্ত্রশস্ত্রও পেয়েছে। কিছু কিছু গোষ্ঠী পূর্ববর্তী সরকারের সাথে অস্ত্র বিরতি চুক্তিও করেছিল, যে চুক্তিগুলো এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এই জাতিগত গোষ্ঠীগুলো দেশকে ধ্বংস করতে চায় – সেনাবাহিনীর এমন প্রচারণা বিশ্বাস করার জন্য পিডিএফ এখন তাদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে।

পিডিএফ এখন এমন একটি ভবিষ্যৎ কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার কথা বলছে যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে।

একজন নান – যিনি ২০২১ সালে অভ্যুত্থানের পর বিক্ষোভকারীদের রক্ষা করতে পুলিশের সামনে হাঁটু গেড়ে অবস্থান নেয়ার কারণে আলোচনায় এসেছিলেন, তিনি বিবিসিকে বলেন, অভ্যুত্থানের পর যে রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ হয়েছে জনজীবনে তার একটা ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

সিস্টার অ্যান রোজ নু তং বলেন, ‘শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ, অর্থনীতি ও জীবিকা – সবকিছুই ভেঙ্গে পড়েছে।’

‘ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে সন্তান প্রতিপালন করতে অক্ষম হয়ে পড়ায় কেউ কেউ গর্ভপাত করিয়েছেন। কারণ পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে পারছেন না কারণ তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।’

কিন্তু যেসব তরুণ-তরুণী যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তাদের প্রশংসা করেন এই নান। ‘তারা সাহসী। গণতন্ত্রের জন্য, দেশের ভালোর জন্য, শান্তির জন্য এবং দেশকে সেনাশাসন থেকে মুক্ত করার জন্য জীবন বাজি রাখতে তাদের আপত্তি নেই। আমি তাদের প্রশংসা করি। আমি তাদের জন্য গর্বিত। তাদের আমি সম্মান করি।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা