ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ইতিহাসের সবথেকে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। রাশিয়ার তোপের মুখে পড়েছে পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম কিংবা টুইটারের মতো জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে গুগল। গুগলের ম্যাপ, জিমেইল, সার্চ এবং ইউটিউব সবই রাশিয়াতে চলছে। আবার পশ্চিমা কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় ব্যবসা ও সেবা বন্ধ করে দিলেও গুগল তা করছে না।
এমন নয় যে, রাশিয়া গুগলকে ধরে রাখতে চাইছে বা সে জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে। উল্টো দেশটি নিজের নাগরিকদের ইন্টারনেট ব্যবহারে উঁচু প্রাচীর তৈরি করতে চায়। এমনকি গুগলের বিরুদ্ধে নানা সময়ে মামলা দায়ের করে চলেছে রুশ সরকার। গত শুক্রবারই রাশিয়ার মধ্যে রুশ ব্যবহারকারীদের তথ্য জমা করার প্রক্রিয়া চালু না করায় গুগলের বিরুদ্ধে নতুন মামলা করা হয়েছে। এর আগে গুগলের রুশ শাখার ব্যাংক একাউন্টগুলো জব্দ করে রুশ সরকার।এরফলে এখন দেশটিতে গুগলের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখন থেমে আছে। সিএনএনকে গুগল রাশিয়ার এক মুখপাত্র জানান, রুশ সরকারের এমন পদক্ষেপের কারণে এখন কর্মীদের বেতন দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না, স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা দূরে থাক।
তবে এরপরেও গুগলের রাশিয়া ছাড়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। ওই মুখপাত্র বলেন, আমরা সামনের দিনগুলোতেও রাশিয়ায় ইউটিউব, সার্চ, জিমেইল, ম্যাপ, এন্ড্রয়েড এবং প্লে সার্ভিস অব্যাহত রাখবো। এতে করে রুশরা মানসম্মত তথ্য থেকে বঞ্চিত হবে না। যদিও যুদ্ধ শুরুর পর গুগল রুশ চ্যানেলগুলোকে ব্যান করে দেয়।
তারপরেও রাশিয়ার গুগল বন্ধের কোনো পরিকল্পনা আছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। রাশিয়ার ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট মন্ত্রী মাকসুত শাদায়েভ জানিয়েছেন, ইউটিউব পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয়ার কোনো ইচ্ছা রাশিয়ার নেই। তিনি বলেন, আমরা যখন কোনো কিছু নিষিদ্ধের কথা ভাবি, তখন আমরা আমাদের দেশীয় ব্যবহারকারীদের স্বার্থের কথাও ভাবি।
রাশিয়ায় ১০ কোটিরও বেশি সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে। আর সে কারণে রাশিয়া ছেড়ে আসা গুগলের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। রুশ মার্কেটে গুগল এরইমধ্যে ভাল অবস্থানে রয়েছে। গুগল এখন যুদ্ধ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তাহলে পরিস্থিতি তাদের জন্য সহজ হবে। তাছাড়া একবার রাশিয়া ছেড়ে আসলে, আবারও এই বাজার ফিরে পাওয়া গুগলের জন্য অসম্ভব হয়ে যাবে। কারণ, রাশিয়া নিজেও এখন নিজস্ব প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে বাজার দখলে উৎসাহিত করে যাচ্ছে।
তবে অনেক ইন্টারনেট এক্সপার্টই এই দাবির সঙ্গে একমত নন। তারা বলছেন, শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেই গুগল রাশিয়ার বাজার আঁকড়ে ধরে নেই। তারা এটিকে নৈতিক দায়িত্ব মনে করছে। স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার পলিসি সেন্টারের পরিচালক ডাফনি কেলার বলেন, গুগলের নৈতিক অবস্থানটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। গুগল চলে এলে রুশদের কাছে তথ্যদের জন্য রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প থাকবে না। তাই রুশদের কাছে তথ্যপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে গুগলের রাশিয়ায় থাকা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ।
এ নিয়ে গুগলকে প্রশ্ন করা হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি কোম্পানিটি। তবে ইউটিউবের সিইও সুসান জানান, আমরা এখনও রাশিয়ায় সেবা দিয়ে যাচ্ছি কারণ আমরা বিশ্বাস করি, রাশিয়ার নাগরিকরা আমাদের মাধ্যমে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের খবর দেখতে পাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বসে যে খবর দেখা যাচ্ছে, রুশ নাগরিকরাও তাই দেখতে পাচ্ছেন। এরফলে রুশরা জানতে পারছেন যে, রাশিয়ার বাইরে আসলে কী হচ্ছে।
তবে রাশিয়া নিজেই চাইলে গুগল বন্ধ করে দিতে পারে কিন্তু সেরকম কোনো আভাস এখনও পাওয়া যায়নি। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সামনে একটি সুযোগ এসেছে, যেটি ব্যবহার করে দেশটি নিজেদের ইন্টারনেটকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। বিকল্প হিসেবে নিজেদের মধ্যে একটি ভিন্ন ইন্টারনেট পদ্ধতি তৈরি করতে পারে। তবে এখনও সেরকম কোনো বিকল্প চালু না হওয়ায় গুগলকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না।
তাছাড়া, ইউটিউব রাশিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। রাশিয়া সরকার এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের বার্তা দিতে পারছে। আবার রুশ কনটেন্ট ক্রিয়েটররা দেশের মানুষকে সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে বলতে পারছে। আরটি এবং স্পুটনিকের মতো চ্যানেলগুলোর ইউটিউবের কোটি সাবস্ক্রাইবার আছে। ফলে ইউটিউব চালু থাকা রাশিয়ার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ায় ফেসবুকের বিকল্প হিসেবে ভিকে আছে। গুগলের বিকল্প ইয়ানডেক্স আছে। কিন্তু ইউটিউবের কোনো বিকল্প নেই। সরকার রুটিউব চালুর চেষ্টা করলেও তা জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
ইন্টারনেট গবেষকরা বলছেন, ইউটিউব বন্ধ করে দিলে রাশিয়ানরা তাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করতে পারে কারণ এখনও এর কোনো বিকল্প নেই। আর এ কারণেই অন্য সব সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ হলেও ইউটিউবের ক্ষেত্রে তা করছে না রুশ সরকার।