০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ মার্চ ২০২৪, ১০ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ইউক্রেনে যুদ্ধ নাকি যুদ্ধের নাটক?

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৯:৪৮:২৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২২
  • 21

ইউক্রেন সীমান্তে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেনা মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। বেলারুশের সঙ্গে মিলে একটি সামরিক মহড়ার ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন তিনিও ধারণা করছেন, ইউক্রেন দখল করতে যাচ্ছে রাশিয়া। কিয়েভের মার্কিন দূতাবাস থেকে কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তও নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।

আর এদিকে যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের বর্তমান সরকারকে সরিয়ে রাশিয়াপন্থী কাউকে ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্র করছে মস্কো।

ইউক্রেনে বড়সড় একটি সামরিক আক্রমণের সব ধরনের পূর্বাভাসই পাওয়া যাচ্ছে এখন।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা শক্তিরা রাশিয়াকে এই আক্রমণ থেকে বিরত রাখতে যত ধরনের হুমকি দেওয়া সম্ভবত দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই সংকট তৈরি করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন একা। কেবল পুতিনই জানেন কোনদিকে মোড় নিবে এ সংকট।

পশ্চিমা শক্তিরা এ ব্যাপারে বেশ অন্ধকারে আছে। পুতিন কেন এ কাজ করছেন, কিংবা আদৌ করছেন কি না- সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই তাদের।

পশ্চিমা মিডিয়া ও সরকারগুলোর সৌজন্যে গত কয়েক দশক ধরে পুতিনকে ‘ঠাণ্ডা মাথার ভিলেন’ হিসেবে জেনে আসছে সবাই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ব্যক্তি হিসেবে পুতিন আদতে খুবই আবেগপ্রবণ, রাগী ও দাম্ভিক।

২০১৪ সালে এক গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছাড়া হন তৎকালীন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ও পুতিনের মিত্র ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দখল করেন পুতিন।

রাশিয়া যখন এই অভিযান চালায়, তখন কেউই জানত না কখন থামবে এই আগ্রাসন। পুতিন নিজেও হয়তো জানতেন না। দখলকৃত এলাকায় এই সাত বছরে জায়গা-জমির দখল নিয়েছে রাশিয়ানরা, ইউক্রেনীয়দের রেখেছে শোষণের উপর। কিন্তু তারা এতসব করেছে এবং করে যাচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই।

২০১৪ সালের ওই অভিযান রাশিয়ায় একরকম জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দিয়েছিল, পুতিনকে সাহায্য করেছিল তার দুর্বলতা ঢাকতে। সাত বছর পর এখন আরেকটি রক্তাক্ত সংঘর্ষের মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাশিয়া। পুতিন আগে দেখিয়েছেন, তিনি একটি অঞ্চল দখল করে তার উপর জেঁকে বসতে পারেন। দিনশেষে সবাই এর সাথে অভ্যস্ত হতে বাধ্য।

কিন্তু, সাধারণ রুশরা এই আগ্রাসনের ব্যাপারে নিশ্চিত না। ইউক্রেনে তাদের স্বজাতি স্লাভদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করা অনেক রাশিয়ান এখন প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন, এই আগ্রাসনের আদৌ কোনো অর্থ আছে কি না?

অর্থ থাকলে- সেটা শুধু পুতিনের মাথাতেই আছে। পূর্বে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বহুবার স্মৃতিকাতরতা প্রকাশ করা পুতিন এ কথাও পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ইউক্রেনকে একটি বাস্তব দেশ হিসেবে দেখেন না তিনি। তার মতে, এটি একটি বিদ্রোহী রাজ্য, যা একদিন আবার ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসবে।

এই অভিযানে পুতিন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় পরিস্থিতি সম্বন্ধে পশ্চিমাদের ধারণা আরও সীমিত হয়ে পড়েছে। মার্কিনীরা এ ব্যাপারে রাশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালানোর চেষ্টা করলে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ করার অভিযোগ এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মস্কো।

ইউক্রেন ও ন্যাটো শক্তিদের সঙ্গে সামরিক উত্তেজনা তৈরি করার পিছনে রুশ প্রেসিডেন্টের বাস্তব কারণও থাকতে পারে। এই বিষয়টি এখন আর কারোরই অজানা নয় যে পুতিনের সরকার ব্যবস্থা বলতে গেলে একটি মাফিয়া। ক্রেমলিনের রাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করে পুতিন ও পুতিন নিয়ন্ত্রিত কোটিপতি ব্যবসায়ীরা।

রাশিয়ার বৈদেশিক নীতির এই দিকটিও আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যুক্তরাষ্ট্র যদি পুতিনের অধীনে কাজ করা এই রাশিয়ান শোষকগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে তৎপর হয়, তাহলে হয়তো ইউরোপীয় সমর্থন পেতে পারে তারা। লন্ডনে জমা থাকা রুশ অভিজাতদের সম্পদ জব্দ করে, পশ্চিমা স্কুলগুলো থেকে তাদের সন্তানদের বিতাড়িত করে এবং আরও নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুতিনপন্থীদের কোণঠাসা করে দিতে পারে তারা।

তবে, এক্ষেত্রে ঝামেলা হচ্ছে, এই আগ্রাসন কখনোই শুধু একমুখী হবে না। বিশ্বজুড়ে পুতিনের ভৃত্য রাশিয়ান কোটিপতিদের উপর পশ্চিমা শক্তিরা চড়াও হলে এটি আর কোনো সভ্য কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আলোচনা হিসেবে থাকবে না। অনেক উগ্র রূপ ধারণ করবে এ সংকট।

বাইডেন অবশ্য এমন হুমকি দেওয়ার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু তাতে একেবারেই কান দেয়নি ক্রেমলিন। কেননা, এই হোয়াইট হাউসকে ভালোভাবেই চেনে তারা। ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সাহসী পদক্ষেপটি ছিল এমন- ২০১৪ সালে রাশিয়ান আগ্রাসন এড়াতে টুইটারে হ্যাশট্যাগ যুদ্ধ চালিয়েছিল তারা (তখনও ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাইডেন)।

আর ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে সাহায্য করার জন্যও প্রস্তুত না পশ্চিমা শক্তি। ন্যাটো জোটে না থাকা একটি দেশের জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের।

কীভাবে এই ইউক্রেন সংকট সামাল দিবে তা নিয়েই একমত না ন্যাটো শক্তিরা। যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটোর কয়েকটি রাষ্ট্র ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য পাঠিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি খাতে সম্পর্ক ধরে রাখতে ইচ্ছুক জার্মানি এখনও নিরপেক্ষ থাকছে এ সংকটে। এ সপ্তাহে জার্মান নৌবাহিনীর প্রধান প্রকাশ্যে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিলে তাকে পদচ্যুত করতে বাধ্য হন চ্যান্সেলর ওলাফ শুলৎস। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জোট গড়ার নমুনা কখনো এটি হতে পারে না।

তাহলে আর কী বাকি থাকছে? মার্কিন নেভাল ওয়ার কলেজে কর্মরত দীর্ঘদিনের রাশিয়া পর্যবেক্ষক নিকোলাস গভোসদেভ বিশ্বাস করেন, পশ্চিমারা যদি রুশ অভিজাত গোষ্ঠীর উপর গুরুতর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ না করে, তাহলে একটি পথই বাকি থাকবে- “কূটনৈতিক কৌশল”। রাশিয়ার অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে হবে ওয়াশিংটনকে। এবং “যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে” সম্ভাব্য সমঝোতা আলোচনা চালিয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

পশ্চিমাদের মাথা নত করিয়ে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে যদি পুতিন একে ন্যাটো ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিজয় বলে ঘোষণা করেন, তাহলে এখানেই থেমে যেতে পারে সংকট। পশ্চিমা শক্তিদের ভয় পাইয়ে দিয়ে পুতিন হয়তো কিয়েভকে এই বার্তা দিতে চাইবেন- ‘তোমাদের কোনো মিত্র নেই পুরো বিশ্বে’। এবং এই ধারায় ইউক্রেন সরকারকে অস্থিতিশীল করে নিজের পছন্দসই কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চাইবেন তিনি।

তবে পুতিনের উদ্দেশ্য যদি যুদ্ধে যাওয়াই হয়ে থাকে, তাহলে কারোরই কিছু করার নেই। চাইলে পুরো ইউক্রেনকে দখল করে নিতে পারে রাশিয়া (যদিও তা অর্থ ও জনবল ক্ষয়, সবভাবেই বেশ ব্যয়বহুল হবে)।

আবার সামরিক উত্তেজনাকে ব্যবহার করে ইউক্রেনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারেন পুতিন, যা সেদেশে হতাহতের সংখ্যা বাড়াবে এবং একসময় বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে। অথবা আগেরবারের মতো ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল দখল করে পরবর্তী আলোচনার জন্য ক্রেমলিনের হাতকে আরও শক্তিশালী করতে পারেন তিনি।

সমস্যা হচ্ছে, সামরিক অভিযান শুরু হয়ে গেলে ক্রেমলিন কী করবে তা কেউই অনুমান করতে পারবে না। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তখন হয়তো ক্রেমলিনের হাতেও থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা শুধু আশা করতে পারে, পুতিন আরেকটি শেষ চাল খেলবেন তাদের সঙ্গে। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে তাদের।

এসময়ে যেকোনো কূটনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্তে ভুল ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। মার্কিন ও ন্যাটোর সেনারা যেন কোনো ভুল না করে বসে, সেদিকেও তাদের নজর রাখতে হবে।

এই মুহূর্তে সামরিক উত্তেজনার কারণ ও সম্ভাব্য পরিণতি শুধু ভ্লাদিমির পুতিনই জানেন। এবং ইউরোপকে আরেকটি বড় যুদ্ধের হাত থেকে শুধু তিনিই রক্ষা করতে পারেন।

ক্রেমলিনকে প্রভাবিত করতে পশ্চিমা শক্তিরা কতটা অক্ষম, সেটা এখন স্বীকার করার সময় এসেছে তাদের। তবে যেসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো, সেগুলো নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে তাদের। রাশিয়া সত্যিই একটি পূর্ণ মাত্রার সামরিক আগ্রাসন চালালে সামনে এরজন্য যেন তাদের যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে বাইডেন ও তার মিত্রদের।

Tag :
About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

ইউক্রেনে যুদ্ধ নাকি যুদ্ধের নাটক?

Update Time : ০৯:৪৮:২৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২২

ইউক্রেন সীমান্তে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেনা মোতায়েন অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। বেলারুশের সঙ্গে মিলে একটি সামরিক মহড়ার ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন তিনিও ধারণা করছেন, ইউক্রেন দখল করতে যাচ্ছে রাশিয়া। কিয়েভের মার্কিন দূতাবাস থেকে কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তও নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।

আর এদিকে যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের বর্তমান সরকারকে সরিয়ে রাশিয়াপন্থী কাউকে ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্র করছে মস্কো।

ইউক্রেনে বড়সড় একটি সামরিক আক্রমণের সব ধরনের পূর্বাভাসই পাওয়া যাচ্ছে এখন।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো পশ্চিমা শক্তিরা রাশিয়াকে এই আক্রমণ থেকে বিরত রাখতে যত ধরনের হুমকি দেওয়া সম্ভবত দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই সংকট তৈরি করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন একা। কেবল পুতিনই জানেন কোনদিকে মোড় নিবে এ সংকট।

পশ্চিমা শক্তিরা এ ব্যাপারে বেশ অন্ধকারে আছে। পুতিন কেন এ কাজ করছেন, কিংবা আদৌ করছেন কি না- সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই তাদের।

পশ্চিমা মিডিয়া ও সরকারগুলোর সৌজন্যে গত কয়েক দশক ধরে পুতিনকে ‘ঠাণ্ডা মাথার ভিলেন’ হিসেবে জেনে আসছে সবাই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, ব্যক্তি হিসেবে পুতিন আদতে খুবই আবেগপ্রবণ, রাগী ও দাম্ভিক।

২০১৪ সালে এক গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছাড়া হন তৎকালীন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ও পুতিনের মিত্র ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রিমিয়া এবং ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল দখল করেন পুতিন।

রাশিয়া যখন এই অভিযান চালায়, তখন কেউই জানত না কখন থামবে এই আগ্রাসন। পুতিন নিজেও হয়তো জানতেন না। দখলকৃত এলাকায় এই সাত বছরে জায়গা-জমির দখল নিয়েছে রাশিয়ানরা, ইউক্রেনীয়দের রেখেছে শোষণের উপর। কিন্তু তারা এতসব করেছে এবং করে যাচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই।

২০১৪ সালের ওই অভিযান রাশিয়ায় একরকম জাতীয়তাবাদী আবেগ উস্কে দিয়েছিল, পুতিনকে সাহায্য করেছিল তার দুর্বলতা ঢাকতে। সাত বছর পর এখন আরেকটি রক্তাক্ত সংঘর্ষের মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাশিয়া। পুতিন আগে দেখিয়েছেন, তিনি একটি অঞ্চল দখল করে তার উপর জেঁকে বসতে পারেন। দিনশেষে সবাই এর সাথে অভ্যস্ত হতে বাধ্য।

কিন্তু, সাধারণ রুশরা এই আগ্রাসনের ব্যাপারে নিশ্চিত না। ইউক্রেনে তাদের স্বজাতি স্লাভদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করা অনেক রাশিয়ান এখন প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন, এই আগ্রাসনের আদৌ কোনো অর্থ আছে কি না?

অর্থ থাকলে- সেটা শুধু পুতিনের মাথাতেই আছে। পূর্বে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বহুবার স্মৃতিকাতরতা প্রকাশ করা পুতিন এ কথাও পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ইউক্রেনকে একটি বাস্তব দেশ হিসেবে দেখেন না তিনি। তার মতে, এটি একটি বিদ্রোহী রাজ্য, যা একদিন আবার ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসবে।

এই অভিযানে পুতিন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় পরিস্থিতি সম্বন্ধে পশ্চিমাদের ধারণা আরও সীমিত হয়ে পড়েছে। মার্কিনীরা এ ব্যাপারে রাশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালানোর চেষ্টা করলে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ করার অভিযোগ এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মস্কো।

ইউক্রেন ও ন্যাটো শক্তিদের সঙ্গে সামরিক উত্তেজনা তৈরি করার পিছনে রুশ প্রেসিডেন্টের বাস্তব কারণও থাকতে পারে। এই বিষয়টি এখন আর কারোরই অজানা নয় যে পুতিনের সরকার ব্যবস্থা বলতে গেলে একটি মাফিয়া। ক্রেমলিনের রাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করে পুতিন ও পুতিন নিয়ন্ত্রিত কোটিপতি ব্যবসায়ীরা।

রাশিয়ার বৈদেশিক নীতির এই দিকটিও আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যুক্তরাষ্ট্র যদি পুতিনের অধীনে কাজ করা এই রাশিয়ান শোষকগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে তৎপর হয়, তাহলে হয়তো ইউরোপীয় সমর্থন পেতে পারে তারা। লন্ডনে জমা থাকা রুশ অভিজাতদের সম্পদ জব্দ করে, পশ্চিমা স্কুলগুলো থেকে তাদের সন্তানদের বিতাড়িত করে এবং আরও নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুতিনপন্থীদের কোণঠাসা করে দিতে পারে তারা।

তবে, এক্ষেত্রে ঝামেলা হচ্ছে, এই আগ্রাসন কখনোই শুধু একমুখী হবে না। বিশ্বজুড়ে পুতিনের ভৃত্য রাশিয়ান কোটিপতিদের উপর পশ্চিমা শক্তিরা চড়াও হলে এটি আর কোনো সভ্য কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আলোচনা হিসেবে থাকবে না। অনেক উগ্র রূপ ধারণ করবে এ সংকট।

বাইডেন অবশ্য এমন হুমকি দেওয়ার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু তাতে একেবারেই কান দেয়নি ক্রেমলিন। কেননা, এই হোয়াইট হাউসকে ভালোভাবেই চেনে তারা। ইউক্রেনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সাহসী পদক্ষেপটি ছিল এমন- ২০১৪ সালে রাশিয়ান আগ্রাসন এড়াতে টুইটারে হ্যাশট্যাগ যুদ্ধ চালিয়েছিল তারা (তখনও ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাইডেন)।

আর ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে সাহায্য করার জন্যও প্রস্তুত না পশ্চিমা শক্তি। ন্যাটো জোটে না থাকা একটি দেশের জন্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের।

কীভাবে এই ইউক্রেন সংকট সামাল দিবে তা নিয়েই একমত না ন্যাটো শক্তিরা। যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটোর কয়েকটি রাষ্ট্র ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য পাঠিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি খাতে সম্পর্ক ধরে রাখতে ইচ্ছুক জার্মানি এখনও নিরপেক্ষ থাকছে এ সংকটে। এ সপ্তাহে জার্মান নৌবাহিনীর প্রধান প্রকাশ্যে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিলে তাকে পদচ্যুত করতে বাধ্য হন চ্যান্সেলর ওলাফ শুলৎস। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জোট গড়ার নমুনা কখনো এটি হতে পারে না।

তাহলে আর কী বাকি থাকছে? মার্কিন নেভাল ওয়ার কলেজে কর্মরত দীর্ঘদিনের রাশিয়া পর্যবেক্ষক নিকোলাস গভোসদেভ বিশ্বাস করেন, পশ্চিমারা যদি রুশ অভিজাত গোষ্ঠীর উপর গুরুতর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ না করে, তাহলে একটি পথই বাকি থাকবে- “কূটনৈতিক কৌশল”। রাশিয়ার অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে হবে ওয়াশিংটনকে। এবং “যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে” সম্ভাব্য সমঝোতা আলোচনা চালিয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

পশ্চিমাদের মাথা নত করিয়ে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে যদি পুতিন একে ন্যাটো ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিজয় বলে ঘোষণা করেন, তাহলে এখানেই থেমে যেতে পারে সংকট। পশ্চিমা শক্তিদের ভয় পাইয়ে দিয়ে পুতিন হয়তো কিয়েভকে এই বার্তা দিতে চাইবেন- ‘তোমাদের কোনো মিত্র নেই পুরো বিশ্বে’। এবং এই ধারায় ইউক্রেন সরকারকে অস্থিতিশীল করে নিজের পছন্দসই কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চাইবেন তিনি।

তবে পুতিনের উদ্দেশ্য যদি যুদ্ধে যাওয়াই হয়ে থাকে, তাহলে কারোরই কিছু করার নেই। চাইলে পুরো ইউক্রেনকে দখল করে নিতে পারে রাশিয়া (যদিও তা অর্থ ও জনবল ক্ষয়, সবভাবেই বেশ ব্যয়বহুল হবে)।

আবার সামরিক উত্তেজনাকে ব্যবহার করে ইউক্রেনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারেন পুতিন, যা সেদেশে হতাহতের সংখ্যা বাড়াবে এবং একসময় বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে। অথবা আগেরবারের মতো ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল দখল করে পরবর্তী আলোচনার জন্য ক্রেমলিনের হাতকে আরও শক্তিশালী করতে পারেন তিনি।

সমস্যা হচ্ছে, সামরিক অভিযান শুরু হয়ে গেলে ক্রেমলিন কী করবে তা কেউই অনুমান করতে পারবে না। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তখন হয়তো ক্রেমলিনের হাতেও থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা শুধু আশা করতে পারে, পুতিন আরেকটি শেষ চাল খেলবেন তাদের সঙ্গে। তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে তাদের।

এসময়ে যেকোনো কূটনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্তে ভুল ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। মার্কিন ও ন্যাটোর সেনারা যেন কোনো ভুল না করে বসে, সেদিকেও তাদের নজর রাখতে হবে।

এই মুহূর্তে সামরিক উত্তেজনার কারণ ও সম্ভাব্য পরিণতি শুধু ভ্লাদিমির পুতিনই জানেন। এবং ইউরোপকে আরেকটি বড় যুদ্ধের হাত থেকে শুধু তিনিই রক্ষা করতে পারেন।

ক্রেমলিনকে প্রভাবিত করতে পশ্চিমা শক্তিরা কতটা অক্ষম, সেটা এখন স্বীকার করার সময় এসেছে তাদের। তবে যেসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো, সেগুলো নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে তাদের। রাশিয়া সত্যিই একটি পূর্ণ মাত্রার সামরিক আগ্রাসন চালালে সামনে এরজন্য যেন তাদের যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে বাইডেন ও তার মিত্রদের।